ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৮২ শতাংশ শেয়ার দখল করে রেখেছে এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে থাকা ব্যক্তি ও কোম্পানি। সরকার পতনের পর শেয়ার বিক্রি করে অর্থ লুট করার পাঁয়তারা করছে গ্রুপটি। এসব অর্থ বের করে নিলে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এ অবস্থায় ব্যাংকটির শেয়ারের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। মাত্র দেড় মাসেই ব্যাংকটির শেয়ারের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির শেয়ারের এই ‘অস্বাভাবিক’ দাম বাড়ার কারণ খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। গতকাল বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তাকে (সিআরও) তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে বিএসইসি। ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত করে বিএসইসির সার্ভিলেন্স বিভাগে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
বিএসইসির দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, গত ৬ অগাস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারদর যে হারে বাড়ছে তা ‘অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক’ । শেয়ার লেনদেনে কোনো ধরনের ‘ইনসাইডার ট্রেডিং’, ‘কারসাজি’ বা অন্য কোনো ধরনের ‘অনিয়ম’ হয়েছে কি না, তা খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ফ্লোর প্রাইস ৩২ টাকা ৬০ পয়সায় ক্রেতা ছিলো না। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরেই একই চিত্র ছিলো। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ব্যাংকটির শেয়ারে জোয়ার দেখা দেয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর ইসলামী ব্যাংকের প্রতিটি শেয়ারের দাম ছিলো ৩৯ টাকা ২০ পয়সা। সেখান থেকে দফায় দফায় দাম বেড়ে বুধবার প্রতিটি শেয়ারের দাম ৭০ টাকা ৪০ পয়সায় উঠেছে। অর্থাৎ ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিটি শেয়ারের দাম ৩০ টাকার ওপরে বেড়েছে।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ৬ আগস্ট থেকে গতকাল পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারের দাম প্রায় ৩৮ টাকা বা ১১৬ শতাংশ বেড়েছে। অর্থাৎ দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেড় মাসে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার বদলের পর ইসলামী ব্যাংককে এস আলমমুক্ত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পর থেকে ব্যাংকটির শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়তে শুরু করে। এ সময়ে শেয়ারটির প্রতি বিনিয়োগকারীদের বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়। বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে।
তারা বলছেন, ইসলামী ব্যাংককে এস আলমমুক্ত করার পর দেশি-বিদেশি পুরোনো উদ্যোক্তাদের অনেকে আবারও এটির মালিকানায় ফিরতে পারেন এমনটিই আশা করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। সেটি হলে বাজার থেকে নতুন করে শেয়ার কিনতে হবে তাদের।
পাশাপাশি পরিচালনা পর্ষদ বদলের ফলে ব্যাংকটির আর্থিক স্বাস্থ্যেরও উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে অনেক বিনিয়োগকারী কোম্পানিটির শেয়ারের প্রতি আগ্রহী হন।
বিএসইসি, ডিএসই ও ইসলামী ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, নামে-বেনামে ইসলামী ব্যাংকের প্রায় ৮২ শতাংশ শেয়ারই এখন এস আলম গ্রুপের হাতে রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা শেয়ার অবরুদ্ধ করা হয়েছে। ফলে বাজারে লেনদেনযোগ্য শেয়ারের পরিমাণ কমে গেছে। তাতে হু হু করে বাড়ছে শেয়ারের দাম।
যেসব প্রতিষ্ঠানের নামে এসব শেয়ার রয়েছে- সেগুলো হলো জেএমসি বিল্ডার্স, বিটিএ ফাইন্যান্স, প্যারাডাইস ইন্টারন্যাশনাল, এবিসি ভেঞ্চারস, এক্সেল ডাইং অ্যান্ড প্রিন্টিং, প্লাটিনাম এনডের্ভাস, এক্সেলশিয়র ইমপেক্স কোম্পানি, গ্র্যান্ড বিজনেস, লায়ন হেড বিজনেস রিসোর্সেস, বিএলইউ ইন্টারন্যাশনাল, আরমাডা স্পিনিং মিলস, কিংসওয়ে এনডের্ভাস, ইউনিগ্লোভ বিজনেস রিসোর্সেস, সোলিড ইনস্যুরেন্স পিসিসি, হলিস্টিক ইন্টারন্যাশনাল, হাই ক্লাস বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, ক্যারোলিনা বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, ব্রিলিয়ান্ট বিজনেস কোম্পানি, ব্রডওয়ে ইম্পেক্স কোম্পানি, পিকস বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, এভাগ্রিন শিপিং, ম্যারাথন ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, কিংস্টোন ফ্লাওয়ার মিলস ও পারসেপ্টা এনডের্ভাস।
ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই মাসে ব্যাংকটির শেয়ারের প্রায় ৩৬ শতাংশই ছিল উদ্যোক্তা-পরিচালকদের হাতে। আগস্টে সেই সংখ্যা কমে শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশে নেমে যায়। ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক এস আলম-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বাদ দেয়ার পর উদ্যোক্তা-পরিচালকদের শেয়ার ধারণের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে।
এস আলম সংশ্লিষ্টরা পর্ষদে না থাকায় তাদের শেয়ারকে এখন আর উদ্যোক্তা-পরিচালকের শেয়ার হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। ফলে এখন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধারণ করা শেয়ারের পরিমাণ বেড়ে গেছে। জুলাইয়ে যেখানে এই পরিমাণ ছিল ৪৩ শতাংশ। আগস্ট শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৩ শতাংশে। এর বাইরে ব্যাংকটির প্রায় ১৮ শতাংশ শেয়ার রয়েছে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও ৯ শতাংশ ব্যক্তিশ্রেণির সাধারণ বিনিয়োগকারীর হাতে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, প্রাতিষ্ঠানিক শেয়ারধারীদের বড় অংশই এস আলম-সংশ্লিষ্ট। এর বাইরে বিদেশি শেয়ারধারীদের মধ্যেও এস আলম-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা রয়েছেন। সব মিলিয়ে এস আলমের হাতেই ব্যাংকটির ৮২ শতাংশ শেয়ার থাকার তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এসব শেয়ার অবরুদ্ধ থাকায় বাজারে শেয়ার সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এতে একটি গোষ্ঠী এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্যাংকটির শেয়ারের দাম বাড়াচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৫ সালে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়া ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার সংখ্যা ১৬০ কোটি ৯৯ লাখ ৯০ হাজার ৬৬৮টি। এর মধ্যে উদ্যোক্তা ও পরিচালকদের কাছে রয়েছে মাত্র দশমিক ১৮ শতাংশ শেয়ার। বাকি শেয়ারের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের কাছে ৭৩ দশমিক ২৭ শতাংশ, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে আট দশমিক ৬৪ শতাংশ এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে ১৭ দশমিক ৯১ শতাংশ।
এমজে/