প্রাথমিক স্তরের এক-পঞ্চমাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরের এক-চতুর্থাংশ স্কুলগামী শিশু শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকিতে আছে বলে প্রকাশ পেয়েছে পিপিআরসি এবং বিআইজিডির গবেষণায়। গবেষণায় বলা হয়, ২০২০ সালের মার্চ থেকে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিশুদের শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের সংকট দেখা দিয়েছে। যেসব শিশু সমাজের দরিদ্র শ্রেণিভুক্ত, তাদের অবস্থা আরও সংকটাপন্ন। অনেক দিন ধরে বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষায় ঘাটতি, শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া, মানসিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যাসহ দীর্ঘমেয়াদি নানান ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কোভিড-১৯-এর কারণে দেশে দরিদ্রতার রূপ কীভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে তা জানতে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশান রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) যৌথভাবে দেশ জুড়ে তিন ধাপে একটি টেলিফোন জরিপ করে। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এটি করা হয়। এই গবেষণার তৃতীয় ধাপের দ্বিতীয় অংশ হলো ‘কোভিড ইমপ্যাক্ট অন এডুকেশন লাইফ অফ চিলড্রেন’।
গতকাল গবেষণার ফল যৌথভাবে উপস্থাপন করেন পিপিআরসির চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এবং বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন। ফলে দেখা গেছে, শিক্ষণ ঘাটতির মুখে রয়েছে প্রাথমিক স্তরের ১৯ শতাংশ এবং মাধ্যমিক স্তরের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। তৃতীয় ধাপের ৬ হাজার ৯৯টি পরিবারের মধ্যে দ্বিতীয় অংশের জরিপে ৪ হাজার ৯৪০টি পরিবারের স্কুলগামী শিশুদের ওপরে গবেষণা করা হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে— স্কুলের ধরন (প্রাথমিক/মাধ্যমিক), স্থান (শহরগ্রাম) এবং লিঙ্গ (পুরুষ/নারী)। হতদরিদ্র, মাঝারি দরিদ্র, ঝুঁকিপূর্ণ দরিদ্র এবং দরিদ্র নয় এমন পরিবারগুলোর ওপরে এই গবেষণা করা হয়।
এমনকি মহামারি শুরুর আগে মাধ্যমিক স্কুলগামী শিশুদের একটি বড় অংশ (২১ শতাংশ) ও প্রাথমিক স্কুলগামী শিশুদের একটি বড় অংশ (১৪ শতাংশ) ঝরে যেত। গ্রামের চেয়ে শহরের বস্তিতে থাকা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিশুদের মধ্যে ঝরে পড়ার হার বেশি। যারা স্কুলে ভর্তি হয়েছিল, মহামারিতে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে তাদের সব রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে। যদিও অনেকেই পড়াশুনা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে, তবুও অধিকাংশ শিক্ষার্থী ছয়টি উপায়ে তাদের পড়াশোনা চালিয়েছে। সঠিক ব্যবস্থা না নেওয়া হলে এর ফলে ভবিষ্যতে শেখার ক্ষমতা কমে যাবে এবং ঝরে পড়ার হার বাড়বে। শহরের শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকি বেশি বলে পরিলক্ষিত হয়েছে। যার মধ্যে নারীদের ২৬ শতাংশ এবং পুরুষদের ৩০ শতাংশ রয়েছে ঝুঁকিতে। যারা অতিদরিদ্র সেসব পরিবারের মাধ্যমিক স্কুলগামী ৩৩ শতাংশ পুরুষ শিক্ষার্থীর কোভিড সৃষ্ট অর্থনৈতিক ধাক্কায় স্কুল ছেড়ে দেওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে।
ফলে আরও দেখা গেছে, দূরবর্তী শিক্ষণের জন্য যে সুবিধা থাকা দরকার, তা আছে বা ব্যবহার করছে ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী। ফলে সরকারি ও বেসরকারি চ্যানেলের মাধ্যমে এই বন্ধে লেখাপড়া শেখার হার খুব কম। অবশ্য যারা দরিদ্র না এবং শহরের বস্তিতে থাকে মাধ্যমিক পর্যায়ের সেসব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই হার একটু বেশি। একই সঙ্গে কোচিং-এ বা প্রাইভেট টিউশনে যাওয়ার প্রবণতা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই বেশি (৬১ শতাংশ) বিশেষত যারা দরিদ্র না, তাদের মধ্যে এই হার বেশি (৭৪ শতাংশ)। আবার শহরের বস্তি এলাকায় খরচ বেশি হওয়ার কারণে কোচিংয়ে যুক্ত হওয়ার হার কম।
পড়াশোনায় যুক্ত থাকার আরেকটি পদ্ধতি হলো পিতামাতা বা ভাই-বোনের সহায়তায় পড়া। যদিও প্রাথমিক পর্যায়ের চেয়ে মাধ্যমিক পর্যায়ে এই সহায়তাপ্রাপ্তির হার কম। যদিও ৯৫ শতাংশ অভিভাবক তাদের সন্তানকে স্কুলে পুনরায় পাঠাতে আগ্রহী। তবুও অর্থনৈতিক অবস্থাটি এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ২০২০ সালের জুন থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত শিক্ষাখরচ বেড়েছে ১২ গুণ। ফলে শিক্ষার সুযোগপ্রাপ্তিতে সংকট তৈরি হয়েছে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, মহামারিতে শিক্ষার্থীদের শহরে বসবাসরত ১০ থেকে ২০ বছর বয়সীরা (১৫ দশমিক ৭ শতাংশ) গ্রামের (৮ দশমিক ৪ শতাংশ) তুলনায় দ্বিগুণ মানসিক চাপে রয়েছে।
ড. ইমরান মতিন বলেন, স্কুলগামী শিশুদের একটা বড় অংশ শিক্ষণ ঘাটতির ঝুঁকিতে রয়েছে। সুতরাং, শিক্ষার ঘাটতি পূরণে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে শিশুদের খাপ খাওয়াতে স্কুল পুনরায় খোলার সময় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থার একটি মিশ্র পদ্ধতি গ্রহণ করা দরকার।
এন-কে