হাতিরঝিলে গড়ে উঠছে ‘অবৈধ’ বহুতল ভবন

রাজধানীর অন্যতম নান্দনিক স্থান হাতিরঝিলের সৌন্দর্য রক্ষা করতে একটি বিশেষ পরিকল্পনা-ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) প্রণয়ন করেছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। ড্যাপ অনুযায়ী হাতিরঝিল ঘিরে ৩০০ মিটার পর্যন্ত নকশা অনুমোদনে পৃথক বিধান রাখা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই এরিয়ার মধ্যে কোনও বহুতল ভবন করা যাবে না। দূর থেকে যাতে ৩৫ ডিগ্রি কৌণিকভাবে হাতিরঝিলকে উপভোগ করা যায়। কিন্তু কর্তৃপক্ষের সেই বিধান অমান্য করে এরই মধ্যে কোনও অনুমোদন ছাড়াই বহুতল ভবন নির্মাণ শুরু করেছেন ভূমি মালিকরা। তাছাড়া ঝিলের বিভিন্ন এলাকায় ৪১টি পকেট গেট অনুমোদিত হলেও বর্তমানে শতাধিক পকেট গেট তৈরি করেছে আশপাশের বাসিন্দারা।

জানা গেছে, হাতিরঝিল এলাকায় নৈসর্গিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য একটি বিশেষ ড্যাপ প্রণয়ন করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এ ড্যাপ প্রণয়নের ফলে হাতিরঝিলের ৩০০ মিটার দূরত্ব পর্যন্ত এলাকায় কাঠামো তৈরি করতে হলে ইমারত আইন ছাড়াও কিছু বিধি-বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে ২০১৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর একটি গেজেটও প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়, হাতিরঝিল এলাকার জন্য প্রণীত বিশেষ ড্যাপ এর সুপারিশ অনুযায়ী কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। তবে, ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে বিদ্যমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ প্রযোজ্য হবে। হাতিরঝিল এলাকায় পরিকল্পিত ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। হাতিরঝিলের পানির গুণগতমান এবং এলাকার নান্দনিক পরিবেশ বজায় রাখার উদ্যোগ নিতে হবে।

এরপর থেকেই হাতিরঝিল এলাকার আশপাশের প্লটের মালিকরা ইমারত নির্মাণের ক্ষেত্রে পড়েন বিপাকে। বিদ্যমান বিশেষ ড্যাপের সঙ্গে ইমারত নির্মাণ আইন-২০০৮-এর সাংঘর্ষিক অবস্থা সৃষ্টি হয়। ফলে ইমারত নির্মাণের শত শত আবেদন ঝুলে থাকলেও কোনও সমাধান করতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। ফলে আবেদনকারীরাই এখন নিজেদের ইচ্ছেমতো অনুমোদন ছাড়াই বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, হাতিরঝিলের দেয়াল ঘেঁষে মগবাজার, মধুবাগ ব্রিজ, রামপুরা, বাড্ডা ও বেগুনবাড়ি এলকায় অর্ধশতাধিক বহুতল ভবন নির্মাণ শুরু হয়েছে। অনেকেই নির্মাণাধীন ভবনের ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য ঝিলের দেয়াল ঘেঁষে বিজ্ঞাপনও ঝুলিয়ে রেখেছেন। অবৈধ ও অনুমোদনহীন গড়ে ওঠা এসব ভবন হাতিরঝিলের সৌন্দর্য নষ্ট করছে। এছাড়া ঝিলের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট পকেট গেট তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় বাড়ির মলিকরা ঝিলের দেয়াল ভেঙে অবৈধভাবে এসব গেট তৈরি করেছে। এসব গেট দিয়ে অবাধে যাতায়াতের কারণে ঝিলে দুর্ঘটনাও ঘটছে। রাজউক সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ৪১টির মতো পকেট গেটের অনুমোদন রয়েছে। তবে বাস্তবে এর পরিমাণ শতাধিক।

ঝিলের মগবাজার মগবাজার রেলগেট সংলগ্ন এলকায় অ্যাসিউর ফেয়ার ভিউ নামে একটি আবাসন কোম্পানির বিশাল বিলবোর্ড ঝুলছে। ঝিলের দেয়াল ঘেঁষেই এই বিজ্ঞাপন বোর্ডটি লাগানো হয়েছে। তাতে ফ্ল্যাট বিক্রির জন্য একটি ফোন নম্বরও দেওয়া রয়েছে। ওই নম্বরে ফোন করা হলে অপরপ্রান্তে থাকা ব্যক্তি কোনও কথা বলতে রাজি হয়নি। এছাড়া মধুবাগ এলাকায়ও বেশ কয়েকটি নির্মাণাধীন বহুতল ভবন দেখা গেছে।

রাজউকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, এরই মধ্যে তারা অবৈধ ও নকশা বহির্ভূতভাবে নির্মাণাধীন বেশ কিছু ভবনের তালিকা তৈরি করছে। তবে এসব ভবন ভাঙার জন্য এখনও কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আর রাজউক চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, হাতিরঝিলের সৌন্দর্য রক্ষায় যা যা করা দরকার তাই করা হবে। আইন বা বিধিমালা লঙ্ঘন করে কোনও ভবন নির্মাণ করতে দেওয়া হবে না।

গেজেট অনুযায়ী, হাতিরঝিলের ৩০০ মিটারের মধ্যে ভবন নির্মাণ করতে হলে প্রণীত বিশেষ ড্যাপের সুপারিশ নিতে হবে। কিন্তু সুপারিশ কোনগুলো হবে তা স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়নি। তবে বিভিন্ন কমিটি, উপকমিটির সুপারিশে বলা হয়েছে, সম্মুখভাগে ছয়তলা পর্যন্ত নির্ধারিত থাকবে। আর এর ভেতরে পর্যায়ক্রমে একটি করে তলা বাড়ানো যাবে। এখানে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ অনুযায়ী ফার, সেটব্যাক ও উচ্চতার বিষয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া হাতিরঝিল প্রকল্পের পাশে ক্ষুদ্র ব্যক্তিমালিকানাধীন প্লট একত্রীকরণ না করে উন্নয়ন করা হলে, সে ক্ষেত্রে প্লট মালিকদের অবশ্যই অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ তৈরি করতে হবে। কোনোভাবেই হাতিরঝিল প্রকল্পের সড়কে অনুমতি দেওয়া যাবে না বলেও সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাতিরঝিল একটি বিশেষ প্রকল্প। এটি রাজধানীর ফুস ফুস হিসেবে খ্যাত। এর সৌন্দর্য রক্ষায় একটি বিশেষ ড্যাপ প্রণয়ন করা হয়েছে। সেই ড্যাপ অনুযায়ী হাতিরঝিল এলাকার চারপাশে ৩০০ মিটার পর্যন্ত নকশা অনুমোদনে ভিন্ন একটি কমিটির সুপারিশ আমলে নিতে হবে।’

জানতে চাইলে রাজউক চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উল্যাহ নূরী বলেন, ‘হাতিরঝিল নিয়ে আমাদের বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে। এর সৌন্দর্য্য রক্ষায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কেউ যদি আইন ও বিধিমালা লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণ করে, সেগুলো উচ্ছেদ করা হবে।’

ইউআর/

- Advertisement -spot_img
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ

- Advertisement -spot_img

এই বিভাগের আরও

- Advertisement -spot_img