বিগত কয়েক বছর ধরে নদী ও সামুদ্রিক প্রাণির আকর্ষিক মৃত্যু বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি কক্সবাজার সৈকতে দুটি মৃত তিমি ভেসে আসার ঘটনায় দেশজুড়ে আলোচনা হচ্ছে। এর আগে হালদায় বেশ কয়েকটি মৃত ডলফিন পাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। শুধু তিমি বা ডলফিন নয় হাঙ্গর ও কচ্ছপসহ বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য বিপন্ন হওয়ার পথে। সামুুদ্রিক জীববৈচিত্রের উপর মানবসৃষ্ট আঘাত কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনে তাদের জীবন হুমকির মুখে পড়ছে বলে মনে করছেন ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএস)সহ পরিবেশবিদরা।
সামুদ্রিক মৎস্য গবেষক ও পরিবেশবিদ গবেষকরা বলছেন, প্লাস্টিকের প্রভাবে ভয়াবহ দূষণের শিকার গভীর সমুদ্র, উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন, পানির নিচে সাবমেরিন, বিভিন্ন বাহিনীর প্রশিক্ষণ মহড়ায় বিধ্বংসী বিস্ফোরণ, বোমা বিস্ফোরণ পরীক্ষণ ও জাহাজ চলাচলের সময় আঘাতের কারণে সামুদ্রিক জীববৈচিত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যার ফলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ডলফিন, তিমি, হাঙ্গর ও কচ্ছপের মতো গভীর সমুদ্র জলের প্রাণিরা।
ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) সিনিয়র আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা ব্রায়ান স্মিথ সিটিজিনিউজকে বলেন, এটি স্পষ্ট নয় যে কি পরিমাণ মৃত তিমির সংখ্যা বাড়ছে। যদিও ডলফিন, পোরপোইজস, হাঙ্গর, সামুদ্রিক কচ্ছপ পাশাপাশি তিমিসহ সমস্ত সামুদ্রিক প্রাণি বিশেষত ফিশিং গিয়ারে জড়িয়ে যাওয়ার ফলে হুমকির সম্মুখীন হয়। তবে মৃত তিমির সংখ্যা কি পরিমাণ বাড়ছে তা নির্ধারণ করার জন্য আমাদের আরও অনেক সময় প্রয়োজন। সম্প্রতি তিমির অবাধ বিচরণের (তিমি, ডলফিনস এবং পোরপাইজিস) জন্য নিরীক্ষণ নেটওয়ার্ক স্থাপন জরুরি এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ নির্ধারণে জোর দেওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, ২০০১ সাল থেকে কক্সবাজারে আটকা পড়ে থাকা সমস্ত তিমির রেকর্ড আমাদের কাছে নেই, তবে ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে কক্সবাজার অঞ্চলে ব্রাইডার জাতের তিমিগুলোর দুটি পৃথক ঘটনার রেকর্ড রয়েছে । এছাড়াও মিঠা পানির ডলফিনসহ ২০০৭ সাল থেকে আমাদের প্রায় ২০০ টি সিটাসিয়ান মারা যাওয়ার রেকর্ড রয়েছে। এসব সামুদ্রিক প্রাণির মৃত্যু প্রকৃত কারণ নিয়ে কখনও রিপোর্ট করা সম্ভব হয়নি।
সম্প্রতি সমুদ্রে তিমির অবাধ বিচরণের প্রতি আরও ভাল যত্ন নেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে ডব্লিউসিএস’র এই বৈজ্ঞানিক বলেন, হুমকিপূর্ণ সামুদ্রিক প্রাণি রক্ষার জন্য এবং টেকসই মৎস্যজীবন নিশ্চিত করা দরকার যা হলো অগ্রাধিকারযোগ্য চ্যালেঞ্জ। ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটি (ডব্লিউসিএস) বিশ্বাস করে যে স্বাস্থ্যকর উপকূলীয় মানুষের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর সমুদ্র অপরিহার্য।
ব্রায়ান স্মিথ আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে তিমিগুলো ফিশিং গিয়ার এবং জাহাজের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে হুমকির মুখে পড়ে থাকে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ক্রিল, কোপপডস, ক্ষুদ্র কাঁকড়া, চিংড়ি এবং ছোট মাছগুলোর জীবনধারা পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।
কক্সবাজারে সম্প্রতি তিমি মৃত্যুর জন্য প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট উভয় কারণে হতে পারে,তবে এজন্য উচ্চতর বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে আরও গবেষণার প্রচেষ্টা জোরদার করা দরকার বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র’র প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.শফিকুর রহমান সিটিজিনিউজকে বলেন, নীলাভ স্বচ্ছ জলরাশি তিমি, হাঙর ও ডলফিনের জন্য উপযুক্ত। কিন্তু সমুদ্রের গভীরে সাবমেরিন, বিভিন্ন বাহিনীর প্রশিক্ষণ মহড়ায় বিধ্বংসী বিস্ফোরণ ও জাহাজ চালচলের সময় আঘাতের কারণে সামুদ্রিক প্রাণিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি আরও বলেন, এই প্রজাতির তিমির খাদ্যাভ্যাস এবং স্বভাবসুলভ বিচরণ ক্ষেত্র গভীর সমুদ্রে। এরা স্বাভাবিকভাবে অল্প পানিতে আসে না। বাংলাদেশে সোয়াচ অব গ্রাউন্ড থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কা, মাদাগাস্কার এবং আন্দামান সাগর হয়ে ওশানিয়া এবং প্যাসিফিক সাগরের গভীর এবং উষ্ণ অঞ্চলে চলাচল করে।
প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শফিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা দু’টি বিষয় সামনে রেখে তিমির নমুনাগুলো পরীক্ষা করে দেখেছি। সেগুলো হচ্ছে— বিষাক্ত কোনো কিছু খেয়ে তিমিটি মারা গেছে নাকি প্লাস্টিক জাতীয় কোনো বস্তু খেয়ে মারা গেছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই দুইটি কারণ আমরা খুঁজে পাইনি। আঘাতের কারণে মারা গেছে কি না সেটি ময়নাতদন্ত রিপোর্টে জানা যাবে। তিমির মূলত ময়নাতদন্ত করবে বনবিভাগের অধীনে ভেটেরিনারি সার্জনরা। এই রিপোর্ট পেতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরপর দুটি মৃত তিমি সাগর থেকে ভেসে এসেছে। তিমি দুটির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। নমুনা পরীক্ষার পর জানা যাবে তিমির মৃত্যু রহস্য। তবে প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করতে পারি তিমি দুটি বয়স্কজনিত কারণে মারা যেতে পারে এবং ১০ থেকে ১২ দিন আগে এই তিমি দুটির মৃত্যু হতে পারে।’