বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও পুরো অঞ্চলের মঙ্গলের জন্য দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চায় চীন। শনিবার (২৮ মে) ঢাকায় বাংলাদেশের সঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পর্যায়ের বৈঠকে দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিয়েছে দেশটি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মনে করছে মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য অনুকূল নয়।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন।
চীনের পক্ষে নেতৃত্ব দেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার সুন ওয়েইতোং। দুই দফা বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যু ছাড়াও কানেক্টিভিটি, ইন্দো-প্যাসিফিক ও চীনের বৈশ্বিক উদ্যোগ গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
প্রথম দফা বৈঠকে রোহিঙ্গা, ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে সহযোগিতা বিষয়ে আলোচনা করা হয়। দ্বিতীয় বৈঠকে অর্থনৈতিক সহযোগিতা, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, কনস্যুলার সহযোগিতা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং রাজনৈতিক সফর বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
চীনের ভাইস মিনিস্টার এমন একসময় ঢাকা সফর করছেন যখন বাংলাদেশের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি নিয়ে দৃশ্যত সরকার অস্বস্তিতে আছে। চীন জিডিআইয়ে বাংলাদেশকে পাশে চায়। বাংলাদেশও চীনের জিডিআই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাংলাদেশ গতকাল চীনকে জানিয়েছে, জিডিআইয়ে যোগ দেওয়ার বিষয়ে সমঝোতা স্মারকের খসড়া নিয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় কাজ করছে।
এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্ভাব্য চীন সফর নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে চীনা পক্ষ। তবে গতকালের বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ইন্দো-প্যাসিফিক, জিডিআই, প্রধানমন্ত্রীর সফরের মতো বিষয়গুলোর উল্লেখ ছিল না।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বৈঠকে উভয় পক্ষ রোহিঙ্গা সংকটসহ অন্যান্য বহুপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বিষয় নিয়েও আলোচনা করে। চীনা প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ, টেকসই ও স্বেচ্ছায় ফিরে যাওয়াকে সহযোগিতা করার আশ্বাস পুনর্ব্যক্ত করেছে।
চীনের ভাইস মিনিস্টার সুন ওয়েইতোং বলেন, দ্রুত প্রত্যাবাসন বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং পুরো অঞ্চলের জন্য মঙ্গলজনক হবে।
পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রথম ব্যাচের প্রত্যাবাসনের সুবিধার্থে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের মিয়ানমারে ‘গো অ্যান্ড সি’ (যাওয়া ও দেখা) সফর এবং বাংলাদেশে ‘কাম অ্যান্ড টক’ (ফিরে আসা ও কথা বলা) সফরের ব্যবস্থা করায় চীনা প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের প্রশংসা করেন।
পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন এ ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য চীনকে ধন্যবাদ জানান। তিনি বন্ধুরাষ্ট্র, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সম্পৃক্ত করে রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও টেকসই প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রোহিঙ্গা ইস্যু চীনের জন্য নিরপেক্ষ মধ্যস্থতাকারী হওয়ার বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। এরই মধ্যে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সমঝোতা করাতে পেরেছে চীন। এরপর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে সেটি চীনের জন্য ভালো একটি অর্জন হবে। এ কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে চীনের বিশেষ আগ্রহ আছে।
উন্নয়ন দেখে মুগ্ধ চীনা ভাইস মিনিস্টার
সুন ওয়েইতোং বৈঠকে জানান, তিনি ১০ বছর পর বাংলাদেশ সফর করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব উন্নয়ন অর্জন দেখে তিনি অত্যন্ত মুগ্ধ হয়েছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, বৈঠকে বাংলাদেশ ও চীনের প্রতিনিধিদলের সদস্যরা পারস্পরিক স্বার্থ এবং বহুপক্ষীয় ফোরামে সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। চীনা প্রতিনিধিদল ‘এক চীন’ নীতিতে অব্যাহত সমর্থনের জন্য বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা পুনর্ব্যক্ত করেছে। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা সাম্প্রতিক উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক সফর বিনিময় ও বৈঠকের কথা স্মরণ করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এই সফরগুলো দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারিকে আরো গভীর করেছে। কভিড-১৯ মহামারি মোকাবেলায় টিকার ক্ষেত্রে সহায়তার জন্য বাংলাদেশ আবারও চীনকে ধন্যবাদ জানিয়েছে।
চলমান প্রকল্পগুলোর পর্যালোচনা
বৈঠকে উভয় পক্ষ বাংলাদেশে চলমান বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে। বিশেষ করে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল এবং পদ্মা সেতু রেল সংযোগের মতো মেগাপ্রকল্পের আসন্ন উদ্বোধনকে তারা স্বাগত জানায়। বৈঠকে উভয় পক্ষই বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ খাতের আরো কয়েকটি প্রকল্প প্রস্তাব সংক্রান্ত অমীমাংসিত ইস্যু দ্রুত সমাধান করতে সম্মত হয়েছে। বৈঠকে চীনের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে জানানো হয়েছে, চীন ভবিষ্যতে বিদেশে কোনো ধরনের কয়লা প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে না।
বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে জোর
২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর কার্যকর হওয়া ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ থেকে চীনে রপ্তানি বৃদ্ধির উপায় নিয়েও বৈঠকে দুই পক্ষ আলোচনা করেছে। চীন প্রয়োজনীয় গুণগত মান বজায় রেখে বাংলাদেশ থেকে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা ও হিমায়িত খাবার আমদানিতে আগ্রহ দেখিয়েছে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে শাক-সবজি, ওষুধ, কাঁচা চামড়া, ফুটওয়্যার ও নন-নিট অ্যাপারেলের মতো রপ্তানি পণ্যকে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ।
চট্টগ্রামে চীনের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনা ফার্মগুলোকে বিনিয়োগে উৎসাহ দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন চীনের ভাইস মিনিস্টার।
বিআরআইয়ের সহযোগিতায় আঞ্চলিক কানেক্টিভিটিতে আগ্রহ
ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) উদ্যোগের পৃষ্ঠপোষকতায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আঞ্চলিক সংযোগে ভূমিকা রাখতে বৈঠকে উভয় পক্ষই আগ্রহ দেখিয়েছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ঢাকা-গুয়াংচু সরাসরি ফ্লাইট আবারও চালু করার আগ্রহের বিষয়ে চীনা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে সময়মতো জানানোর বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা করা হয়েছে। উভয় পক্ষ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভিসাসংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে নিয়মিত কনস্যুলার পরামর্শ চালু করতে সম্মত হয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ও বায়োটেকনোলজি উদ্ভাবনের বিষয়ে চীনের সঙ্গে একত্রে কাজ করার আগ্রহ জানিয়েছে বাংলাদেশ।
প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা পর্যায়ে আলোচনার প্রস্তাব
বৈঠকে উভয় পক্ষ বিদ্যমান প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া প্রতিরক্ষা খাতে নিয়মিত স্টাফ (কর্মকর্তা) পর্যায়ের আলোচনা এবং বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সম্ভাবনা নিয়েও বৈঠকে আলোচনা করা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, অনলাইন জুয়া ও মাদক পাচারের মতো উদীয়মান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা সৃষ্টিতে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে চীন। জননিরাপত্তা ইস্যুতে নিবেদিত সংলাপের বিষয়েও দুই পক্ষ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আবহাওয়া উপগ্রহের তথ্য দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ চীনকে ধন্যবাদ জানিয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা, পদ্মা সেতু পরিদর্শন
চীনের ভাইস মিনিস্টার সুন ওয়েইতোং গতকাল বিকেলে ঢাকার ধানমণ্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তিনি বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন ঘুরে দেখেন। এরপর তিনি পরিদর্শন বইয়ে স্বাক্ষর করেন। বঙ্গবন্ধু জাদুঘর পরিদর্শনের পর চীনের ভাইস মিনিস্টার পদ্মা সেতু পরিদর্শনে যান।
আজ প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ
চীনের ভাইস মিনিস্টার আজ রোববার সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন এবং বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন। সফর শেষে আগামীকাল সোমবার সকালে তিনি শ্রীলঙ্কার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়বেন।
এমজে/