‘মহিউদ্দিন রনির হাত ধরে ঢাবির মেডিক্যাল সেন্টারে আস্তানা গাড়ে প্রলয় গ্যাং?’

প্রলয় গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিক্যাল সেন্টারের কর্মচারীরা। সন্ধ্যার পরেই আসা শুরু হতো গ্যাংয়ের সদস্যদের। হৈ-হুল্লোড়, লাফালাফি করতেন সেন্টারের তিনতলাজুড়ে। বাংলাদেশ রেলওয়ের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ঢাবি শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনির অনশনের পর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিক্যাল সেন্টারকে নিজেদের কার্যালয় হিসেবে রূপান্তর করেন প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যরা।

মেডিক্যাল সেন্টারের এক কর্মচারী বলেন, গত বছরের এপ্রিল মাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পেয়ে সেন্টারে আসেন মহিউদ্দিন রনি। কিন্তু তখন চিকিৎসাসেবাসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা না পাওয়ার অভিযোগ এনে ছয় দফা দাবি আদায়ে মেডিক্যালেই অনশনে বসেন তিনি। তখন তাঁর অনশনকে কেন্দ্র করে মেডিক্যালের ওয়ার্ডগুলোতে আসতে শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী, তাঁর বন্ধু-বান্ধব, পরিবারসহ অনেকে। তখন থেকেই এই প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যদের মেডিক্যাল সেন্টারে যাতায়াত শুরু হয়। রনি মেডিক্যাল সেন্টার ছাড়লেও গ্যাংয়ের সদস্যরা একে তাঁদের আস্তানা বানিয়ে ফেলেন।

প্রলয় গ্যাংয়ের সঙ্গে রনির নাম আসায় বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি মঙ্গলবার দিবাগত রাতে ফেসবুকের এক স্ট্যাটাসে নানা বিষয় তুলে ধরেন।  পাঠাকদের জন্য হুবহু তার স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো।

ফেসবুকে ঢাবি শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনি লেখে, ‘‘মহিউদ্দিন রনির হাত ধরে ঢাবির মেডিক্যাল সেন্টারে আস্তানা গাড়ে প্রলয় গ্যাং? শুধুমাত্র একটি প্রশ্নবোধক চিহ্নের অভাবে খবরের হেডলাইন পড়া গোষ্ঠীর কাছে প্রলয় গ্যাংয়ের গডফাদার হিসেবে কুখ্যাতি পেয়ে গেলাম। এবার আপনাদের কিছু লোমহর্ষক হিন্টস দেই। হিসেব মিলিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আপনার। যদি জিজ্ঞেস করেন প্রলয় গ্যাংয়ের সঙ্গে মহিউদ্দিন রনির সম্পৃক্ততা কি ?’

’ঘটনা ১: এক বছর আগে প্রথমবার, মোবাইল চুরির ঘটনায় প্রলয় গ্যাংয়ের দুই সদস্যকে ঢাবি মেডিক্যাল সেন্টার থেকে বের করে প্রক্টরিয়াল টিমের কাছে তুলে দেই। কিন্ত কি বিচার করেছিল- তার আর আপডেট পাইনি। ঈদের ছুটিতে বাড়ি চলে গিয়েছি। আর খোঁজ নেওয়া হয়নি। ভুলে গিয়েছিলাম।’

‘ঘটনা ২: প্রলয় গ্যাংয়ের একজনকে শনাক্ত করেছি, কিছুদিন আগে টিএসসির মাঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে বেদম মারধর করছিল। সেই ছোটভাইকে সেখান থেকে উদ্ধার করে প্রলয় গ্যাংয়ের এক সদস্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাছে তুলে দেওয়া হয়। এর ছোট্ট একটি অংশের ভিডিও লিংক কমেন্টবক্সে দিচ্ছি। কিন্ত সেবারও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উপযুক্ত বিচার না করায় প্রলয় গ্যাং প্রকট আকার ধারণ করে আজ খবরের পাতায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।’

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ৫ বছর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এরকম অবহেলা দেখতে দেখতে, সুবিচার না পেয়ে এখন আর তাদের কাছ থেকে ভালো কিছুর প্রত্যাশা রাখি না। যেখানে প্রোডাকশন হাউসের মধ্যেই ত্রুটি, সেখান থেকে ভালো প্রোডাক্ট বের হবে- এই প্রত্যাশা রাখাই তো বোকামি। কয়েক বছরের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশৃঙ্খলার দায়ে যে সকল শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার বা ১ বছরের ভ্যাকেশন দিয়েছে তারাই বর্তমানে আরো সংগঠিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক ডিলিং, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কার্যক্রমে লিপ্ত হয়ে ক্যাম্পাসে ত্রাস কায়েম করছে।
একটু খেয়াল করুন এই প্রলয় গ্যাংয়ের উৎপত্তিস্থল কোথায়?’

‘১ম বর্ষে অজপাড়া গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা আত্মীয়, পরিবার ছাড়া শিক্ষার্থীরা ঢাকায় এসে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে। সারা দিন ক্লাস, পেটের ক্ষুধা মেটানো অন্নের যোগান দিতে টিউশন, রাতে গেস্টরুম, গেস্টরুম থেকে বাইরে বের করে দিলে সারারাত রাস্তায় ঘোরা, উদ্যানে মারপিটের হাতেখড়ি, বাসভাঙা, গ্যাঞ্জাম, তারপর সঙ্গদোষে শর্টকার্টে উপার্জনের চেষ্টা, একটা সিট পাওয়ার আশায় শ্রদ্ধেয় বড় ভাইদের আদর্শ হিটার বা বাঘের বাচ্চা উপাধি পাওয়ার প্রবনতায় সকল ন্যায়-অন্যায় হুকুম নিষেধ মেনে চলা, পরের দিন আবার ক্লাস, টিউশন, যথারীতি গেস্টরুম। টানা ৭ দিন এভাবে আধোঘুমে কাটালে যে কেউ বিক্ষিপ্ত, বিচ্ছিন্নতাবাদী আচরণ করবেই। বিশ্বাস না হলে ডাক্তারের কাছে জিজ্ঞেস করে দেখুন। আর দীর্ঘদিনের এই কালচার এখন হয়তো অনেকটা সহনশীল মাত্রায় আছে। আপনি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে না থাকেন, তাহলে আপনি ভাগ্যবান। এতক্ষণ আমি আমার এবং আমার মতো হলে থাকা শিক্ষার্থীদের অবস্থাটা জানালাম।’

‘তাদের মনস্তত্ব বোঝার চেষ্টা করুন দেখবেন, তারা অনেকেই হয়তো ভালো হতে চায়। কিন্ত সঠিক গাইডলাইন, সঙ্গ, মেন্টরশিপ পায় না। আবার যারা ভালো হওয়ার চেষ্টা করছে তাদেরকে ভালো মানুষের মুখোশধারী এক্সট্রিমিস্টদের ধারালো ছুরির মতো মন্তব্য এমনভাবে আঘাত করে যে, এরা ভালো মানুষ হওয়ার চাইতে সন্ত্রাসী হয়ে দমন করাকেই নিরাপদ জীবন যাপন মনে করে। এরা শেল্টার খোঁজে, ভালো শিক্ষক, ভালো বন্ধু, ভালো মানুষেরা শেল্টার দেয় না। শেল্টার দেয় রাজনৈতিক নেতারা নিজেদের চাঁদাবাজির, মাদক ব্যবসার লিগ্যাসি মেইনটেইন করার জন্য। সত্য বলতে প্রকৃতি সবাইকে সমান সুযোগ সুবিধা দেয় না। সুযোগের অভাবে আমরা অনেকেই হয়তো প্রচণ্ড সৎলোক। এদের সুপথে ফেরাতে অবশ্যই সৎ লোকের গ্রুমিং প্রয়োজন।’

‘যেই মন্তব্যের জন্য এক্সট্রিম লেভেলের ভালো মানুষদের ধারালো গালাগাল শুনছি। আমি সেইটা এখনো অকপটে স্বীকার করছি। আমি এইটা উইথড্র করবো না। আর এক্সট্রিম ভালো মানুষরা চায় না হলে থেকে বিগড়ে যাওয়া ছেলেগুলো ভালো হোক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে এবং প্রলয় গ্যাংয়ের সদস্যদের এক্টিভিটি প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক অনুসন্ধানমূলক অপরাধীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার সঙ্গে সাময়িক বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিলে অবশ্যই তাদেরকে আইসোলেটেড করে রিহ্যাবের বন্দোবস্ত করে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সহযোগিতা করার দাবি জানাই।’

‘তিনটি বিষয়ে আলোকপাত করে সত্য ঘটনা উন্মোচনে অনুসন্ধানী সাংবাদিক বন্ধুদের সহযোগিতা কামনা করছি- ১. ইস্যু দিয়ে ইস্যু ঢাকার প্রাচীন পদ্ধতি অবলম্বন করে যারা প্রোডাকশন হাউসকে ছাড় দিতে চাচ্ছে, তারা আসলে কারা এবং কোন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে? যেমন প্রলয় গ্যাং ইস্যুতে ক্যান্টিনের খাবারের দাম বৃদ্ধির ইস্যু যে ধামা চাপা পড়ে যাচ্ছে। দায়িত্বশীলদেরকে কারা ফাঁক থেকে বের করে দিচ্ছে?’

‘২. ঢাবি মেডিক্যাল অফিসার, স্টাফ, কর্মচারীদের আমার আন্দোলন করার সময় রেগুলার ডিউটি করতে হয়েছে। ডাক্তারদের রেগুলার আসতে হয়েছে। বর্তমানে তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে প্রলয় গ্যাং ১ বছর মেডিক্যালে অবস্থান করে কিভাবে? প্রশাসনিক কি ব্যবস্থা নিয়েছে? ইভেন মেডিক্যাল সেন্টারের পরিচালক মহোদয়ের জাল সার্টিফিকেট ইস্যু নিয়ে যে বিতর্ক। সেটা আমার সৃষ্ট এমন ভেবে কি তারা ব্যাকফায়ার করছে? বা তাদের দায়কে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য আমার ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছে?’

‘এই ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক্সট্রিম লেভেলের কিছু ভালো মানুষদের চেনা হলো। ভালো শুধু একাই ভালো। তাই আমিও চাই না সেসব ভালো মানুষের কাতারে নিজেকে তুলতে। আশা রাখি অমানিশার প্রহর শেষ হবে। অন্ধকার কেটে আলো আসবেই।’’

- Advertisement -spot_img
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ

- Advertisement -spot_img

এই বিভাগের আরও

- Advertisement -spot_img