সরকারি আমলাদের ‘স্যার ‘ সম্বোধন কতটা যৌক্তিক?

বাংলাদেশের সরকারি কোন দপ্তর বা মন্ত্রনালয়ে সেবা নিতে কিংবা তথ্য নিতে সাধারণ জনগন অথবা সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে সংশ্লিষ্ঠ কর্মকর্তাদের আচরণ কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ এখন নিয়মিত পাওয়া যায়। শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মিডিয়ায়। মূলত সরকারি আমলাদের ‘স্যার’ ডাকা নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার কারনে ঘটছে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।

ইংরেজি ’SIR” শব্দের বাস্তবিক অর্থ হলো “Slave I Remain”. যার বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায় আমি আপনার অনুগত দাস। ব্রিটিশরা খুব চালাকি করে এই পন্থাটি ভারতবর্ষের কর্মচারীদের উপর ব্যবহার করত। তারা চাইতো ভারতীয়রা সারা জীবন তাদের গোলাম অথবা দাস হয়ে থাকুক। কিন্তু সরাসরি যদি এই কথা ভারতীয়দের বলা হতো তাহলে বিদ্রোহ হবার সম্ভাবনা ছিল। এইজন্যই ইংরেজি শব্দের মাধ্যমে তারা এই কাজটি করতো।

ব্রিটিশরা সাধারণত তাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে “Your Excellency”… এই ভাবে সম্বোধন করত। দু:ক্ষের কথা, ব্রিটিশরা চলে গেছে কিন্তু তাদের উচ্ছিষ্ট ভারতবর্ষে রেখে গেছে। আর এই “SIR” শব্দটিও তাদের ওই উচ্ছিষ্টের একটি অংশ। যদিও আমরা সকলেই এখনও আমাদের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে SIR বলেই সম্বোধন করি। কিন্তু সার্ভিস রেগুলেশনে কোথাও লেখা থাকেনা যে আপনার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে SIR বলতেই হবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে যেহেতু উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে খুশি করা আমাদের অভ্যাস হয়ে গেছে তাই সবকিছু বুঝেও আমরা না বোঝার ভান করে থাকি।

আপনি যদি আপনার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে নামের আগে Mr. যুক্ত করে সম্বোধন করেন তাহলে কোন বাধা নেই এবং আপনার উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ আপনার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। এখানে সরকারি অথবা প্রাইভেট চাকুরীজীবীর ব্যাপারে তেমন কোন ফারাক নেই।

অবাক করা ব্যাপার হলো আমাদের দেশে সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের অধস্তনদের যেভাবে পরিচালনা করে সেভাবেই আমজনতাকেও তাঁদের অধস্তন মনে করে। এর পিছনে কারন হলো তাঁরা অফিসে যতক্ষণ থাকেন ততক্ষন তাঁরা স্যার ডাক শোনেন অথবা বলেন। এটা একরকম অভ্যাসের দাসের মতো। একটি প্রচলিত ধারণা হচ্ছে কর্মকর্তাদের ‘SIR’ বলার সংস্কৃতি শুরু হয়েছে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনকালে। তবে ইতিহাসবিদরা বলেন , ঊর্ধ্বতন কাউকে সম্বোধনের প্রচলন আরও অনেক আগে। তবে তাঁদের মতে সেগুলো ছিল সম্মানসূচক, কখনো উপাধি।

আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে বিষয়টা সবসময় ছিল, সেটা মধ্যযুগ হোক বা মুঘল আমল হোক। যেমন ধরুন জাঁহাপনা, রাজা বাদশাহদের এভাবে সম্বোধন করা হতো। ব্রিটিশ আমলে যখন তাদের ভাষা চালু হল, তখন অন্যান্য সম্বোধনগুলো হারিয়ে হয়ে গেল SIR । ঐ জিনিসটাই এখন হয়েছে ‘অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার’, ‘মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়’, ‘ভিসি মহোদয়’, ‘ডিসি মহোদয় ‘, ‘এসপি মহোদয় ‘, ইত্যাদি। এটা না বললে তারা মনক্ষুন্ন হন।

বাস্তবতা হচ্ছে একটি উপজেলায় যেকোনো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত, প্রকল্প, তার অর্থ, কাগজে সই এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজের এক্সেকিউটিভ অথরিটি রয়েছে একজন ইউএনও’র কাছে। ফলে আপনি যখন অর্থ নিয়ন্ত্রণ করেন, প্রকল্প বন্ধ করে দিতে পারেন, তখন সেই ক্ষমতার কাছে দায়বদ্ধ হয়ে যায় | তাছাড়া স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও তাঁদের ব্যক্তিগত অযোগ্যতা হোক বা তেলবাজির কারনে হোক তিনি একটা সরকার পরিচালিত দলের অনেক বড় নেতা হলেও একজন ইউএনও কে স্যার ডাকতে বাধ্য হন । সরকারি কর্মকর্তারা এই ক্ষমতার জায়গাটা উপভোগ করেন এবং সেটা তারা ছাড়তে চাইবেন না সেটাই স্বাভাবিক। অথচ মজার ব্যাপার হচ্ছে একটা দলের তৃণমূল নেতা ও দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আপা বলে সম্বোধন করেন|

SIR শব্দটি একটি আস্ত বাক্য হয়ে উঠেছে প্রশাসনে
বড় কর্মকর্তারা যখন কোন আদেশ দেন তার জবাবে অধস্তনরা বলেন ‘SIR’। হ্যাঁ কিংবা না নয়, শুধু এই একটি শব্দ। যদি জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি কী কাজটা করেছেন, কেমন আছেন, তারও উত্তর ‘SIR’। এককথায় কোন কিছুর হ্যাঁ সূচক উত্তরই হল SIR।

কিন্তু এই বিষয়টি সিভিল সার্ভিসের প্রশিক্ষণে পড়ানো হয় না। তারপরও পরম্পরায় চলে এসেছে। SIR শব্দে সরকারি কর্মকর্তাদের আত্মপ্রত্যয় বেড়ে যায়। যখন সাধারণ জনগণ তাদের এভাবে দেখে তখন তার মনে হবে SIR বলা ছাড়া তার কোন উপায় নেই।

মূলত সরকারি কর্মকর্তারা তাঁদের কে SIR ডাকা অধিকার মনে করেন | যুক্তি হতে পারে যেহেতু তাদের চাকরির নিশ্চয়তা অন্য যেকোনো পেশার মানুষের চেয়ে বেশি; যেহেতু তারা রাষ্ট্রীয় আইন কানুনের দোহাই দিয়ে অনেক সময় অন্যায় করেও পার পেয়ে যেতে পারেন; যেহেতু তাদের যেকোনো অন্যায় কাজে বাধা দিলেও তারা সেটিকেও রাষ্ট্রীয় কাজে বাধাদান বলে অভিহিত করতে পারেন; যেহেতু অন্যায় করলেও অনেক সময় ‘সরল বিশ্বাসে কৃত অপরাধ’ বলে পার পেয়ে যাওয়ার আইনি সুযোগ রয়েছে— ফলে তাদের মধ্যে অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাস কাজ করে। তারা জানেন সহজে তাদের চাকরি যাবে না। আবার এক সরকারের আমলে চাকরি চলে গেলে পরবর্তী সরকারের আমলে সেই চাকরি ফেরত পাওয়ারও সুযোগ আছে।
নাগরিকদের সেবা না দিলেও মাস শেষে বেতন ঠিকই পাবেন। অবসরে যাওয়ার পরে বিশাল অংকের পেনশন পাবেন। রাজনৈতিক যোগাযোগ ভালো থাকলে অবসরের পরে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পে চুক্তিভিত্তিক কাজের সুযোগ পাবেন। রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে সংসদ সদস্য এমনকি মন্ত্রী হওয়ারও সুযোগ আছে।

আগে উচ্চবিত্ত, সরকারি কর্মকর্তার ছেলেমেয়েরা প্রশাসনে যেত। কিন্তু যে পরিবর্তনটা হয়েছে, যেকোনো শ্রেণির ছেলেমেয়েরা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষ শেষ হওয়ার আগে বিসিএসের জন্য পড়া শুরু করে। তারা অনেকেই খুব মেধাবী নন, তাদের আত্মবিশ্বাস নড়বড়ে থাকে, তবে তারা পরিশ্রমী। যে কখনোই ক্ষমতার উৎসে ছিল না, দক্ষতায় নয় মুখস্থ বিদ্যায় যখন কেউ সরকারি কর্মকর্তা হয় তখন ক্ষমতা তার কাছে নতুন বিষয়। তখন সেটা তাঁর কাছে উপভোগ এর বস্তু হয়ে উঠে । তবে ব্যতিক্রম ও আছে ।

বর্তমানে সরকারিভাবে যারা নতুন করে প্রশাসনে যোগ দেন, তাদের বুনিয়াদি কোর্স দীর্ঘ করা হয়েছে। সেখানে আচরণবিধি, মানবিক আচরণ, এথিকস এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। চাকুরি চলাকালীনও নানারকম কোর্স চলতে থাকে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে গেলে অনেকেই তা আর অনুসরণ করেন না ।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কীভাবে কাজ করতে হবে— সে বিষয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা ছিল- ‘যারা সেবা নিতে আসেন তাদের দিকে তাকাও, তারা তোমার বাবার মতো, ভাইয়ের মতো, আত্মীয়ের মতো। সেবা নিতে আসে জনগণ। তাদের টাকায় তোমাদের বেতন হয়।’

মোঃ সাইফুল ইসলাম
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, দৈনিক দিনের খবর

- Advertisement -spot_img
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ

- Advertisement -spot_img

এই বিভাগের আরও

- Advertisement -spot_img