গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন ইসিকে (নির্বাচন কমিশন) নতুন করে ভাববার পথ তৈরি করে দিয়েছে বলে মনে করেন রাজনীতিবিদসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা। অনিয়মের অভিযোগে একটি সংসদীয় আসনের পুরো ভোট বন্ধ হয়ে যাওয়া নজিরবিহীন ঘটনা; তাই ইভিএম ব্যবহারসহ ইসির সামগ্রিক নির্বাচনি পরিকল্পনার বিষয়টি পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন তারা। অবশ্য সরকারি দল বলছে, স্বাধীন প্রতিষ্ঠান ইসি স্বাধীনভাবে তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ঘটনা প্রমাণ করেছে, সরকার ইসিকে কোনও ধরনের হস্তক্ষেপ করে না। অবশ্য দলটির কোনও কোনও নেতা এই বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগে নির্বাচন কমিশন বুধবার (১২ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধ ঘোষণা করেছে। অনিয়মের কারণে ইসি প্রথমে কয়েক দফায় ৫১টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে। একপর্যায়ে তারা পুরো ভোটই বন্ধ করে দেয়। এর আগে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজেই স্বীকার করেন— গাইবান্ধা নির্বাচন তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। গোপন কক্ষে ঢুকে একজনের ভোট আরেকজনের দেওয়া তারা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন।
প্রসঙ্গত, অতীতে অনিয়ম বা সহিংসতার কারণে নির্বাচনি আসনের এক বা একাধিক কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করা হলেও পুরো ভোট বন্ধের নজির দেখা যায়নি। এবারই প্রথম এই নজির স্থাপন করেছে ইসি। অবশ্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) পুরো ভোট বন্ধ করে দেওয়ার মতো এখতিয়ার কমিশনকে দেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের অধিকার আছে অনিয়মের কারণে ভোটকেন্দ্র এবং ক্ষেত্রমতে পুরো ভোট বন্ধের। তারা আইনের মধ্যে থেকেই এটা করেছে। যদিও আগে কখনও এভাবে পুরো নির্বাচন বন্ধের নজির নেই। তবে নজির না থাকলেও এটা করে নজির সৃষ্টির কোনও অন্যায় হয়নি। আমরা গণমাধ্যমে দেখেছি, নির্বাচন কমিশন বসে পুরো ভোট বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরাও গণমাধ্যমে ভোটকেন্দ্রের গোপন কক্ষে একাধিক মানুষের চলাচল দেখেছি। নির্বাচন কমিশন যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা অন্যায় হয়েছে বলে মনে করি না।’
গাইবান্ধার উপনির্বাচনে অনিয়মের দৃশ্য নির্বাচন কমিশন বসে পর্যবেক্ষণ করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা
গাইবান্ধার উপনির্বাচনে অনিয়মের দৃশ্য নির্বাচন কমিশন বসে পর্যবেক্ষণ করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওই ঘটনার দায় কার, সেটা এই মুহূর্তে মন্তব্য করতে চাই না। কারণ, এ বিষয়ে আমরা নির্বাচন কমিশন বা কারও থেকে কোনও প্রতিবেদন পাইনি। এত দূরে থেকে দায় কারও ওপর চাপানো ঠিক হবে না।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান। তাদের স্বাধীনভাবে চলতে দেওয়া গণতন্ত্রের অন্যতম উপাদান। তাদের সেভাবে চলতে দেওয়া উচিত।’ এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের কোনও দায় আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। সভাপতিমণ্ডলীর অপর সদস্য অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।
আওয়ামী লীগের রংপুর বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন শফিক বলেন, ‘সম্পূর্ণ নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার। কমিশন স্বাধীনভাবে তার ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। আমরাও তার সঙ্গে একমত। আমরা মনে করি, তারা নিজস্ব সক্ষমতা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ নিয়ে কাজ করবে। সরকার তাদের ওপর কোনও হস্তক্ষেপ করতে চায় না।’
অবশ্য আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, গাইবান্ধার ঘটনাটি তাদের জন্য স্বস্তিকর হয়নি। বিষয়টি তাদের বিব্রত করেছে। এই ঘটনা বিরোধী দলের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে বলেও মনে করেন এই নেতা।
ভোট স্থগিতের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধান নির্বাচন কমিশান কাজী হাবিবুল আওয়াল
ভোট স্থগিতের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধান নির্বাচন কমিশান কাজী হাবিবুল আওয়াল
অবশ্য পুরো ভোট বন্ধের আগে ৪৩টি কেন্দ্রের ভোট বন্ধের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে দলটির যুগ্ম সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আমি নিজে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, কোনও কেন্দ্রে নৈরাজ্য বা ভোট নিয়ে অশান্তিকর পরিবেশ হয়নি। বুথের মধ্যে সিসি ক্যামেরা লাগানো অবস্থায় সেটা এখানে বসে (নির্বাচন কমিশন অফিসে) কার কী হাত-পায়ের মুভমেন্ট দেখে এই কেন্দ্রগুলো বন্ধ করা হলো, তা আমাদের কাছে সুস্পষ্ট নয়।’
অনিয়মের কারণে পুরো ভোট বন্ধের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দলের এই নেতা বলেন, ‘পুরো ভোট বন্ধ করে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের মধ্যেই আছে। অনিয়মের জন্য যদি বন্ধ করে থাকে, তাহলে নির্বাচন কমিশনকে সাধুবাদ জানাবো। এর মাধ্যমে অন্তত ইসির প্রতি জনগণের আস্থাবোধ কিছুটা হলেও তৈরি হবে। আর আমরা যে আগেই বলেছিলাম, গোপন কক্ষে গিয়ে ইভিএমে একজনের ভোট অন্যজন দিয়ে দেয়, অর্থাৎ ইভিএম ভোটের নিশ্চয়তা দেয় না, সেটাও বেরিয়ে এসেছে। এই ঘটনা এই শিক্ষা দেয় যে নির্বাচন কমিশনকে সামগ্রিকভাবে নির্বাচনি পরিকল্পনার বিষয়ে নতুন করে পর্যালোচনা করে এগোতে হবে।’
এই ঘটনার জন্য যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন, তাদের দায় রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের এই নেতা। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন করে তো রাজনৈতিক দল। তারা যদি নিয়মনীতি না মানে, তাহলে তো কিছু করার নেই।’
১৪ দলীয় জোটের শরিক জাতীয় পার্টির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন কেন নির্বাচনটি বন্ধ করেছে— নিশ্চয়ই সেটার দেশবাসীর কাছে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেবে। উপনির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন কেন এটা করতে পারলো না, সেজন্য তাদেরও জবাবদিহিমূলক ব্যবস্থা থাকা উচিত।’
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া মনে করেন, পুরো ভোট বন্ধ করে নির্বাচন কমিশন বাড়াবাড়ি করেছে। তিনি বলেন, ‘এটা আরও পর্যালোচনার প্রয়োজন ছিল। আরও যাচাই-বাছাই করে তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারতো। প্রয়োজনে তারা হেলিকপ্টার নিয়ে সেখানে গিয়ে দেখতো।’ তিনি বলেন, ‘এই সিদ্ধান্তটিতে নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা কিন্তু বাড়েনি। বরং তারা নতুন করে বিতর্কিত হয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই এই ঘটনায় রাজনৈতিক দলেরও দায় আছে। নির্বাচনে যারা জয়লাভ করতে চায়, তারা প্রত্যেকেই কিছু ইরেগুলার প্র্যাকটিস করতে চায়।’
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বা তার কর্মীরা কতটা বেপরোয়া, সেটার প্রমাণ হয়েছে এই ভোটে। সিসিটিভিতে মনিটরিং হচ্ছে জেনেও তারা পরোয়া করেনি।’
যে পরিস্থিতি তাতে ভোট বন্ধ না করা ছাড়া ইসির কোনও উপায় ছিল না দাবি করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন একটি উপনির্বাচন করতে পারলো না। তারা ৩০০ আসনে ভোট করবে, সেটা অবান্তর। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না— এই ঘটনায় সেটা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। ইভিএম চালিয়ে দেওয়ার পরীক্ষাটাও চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এর থেকে নির্বাচন কমিশন ও সরকারি দলকে শিক্ষা নেওয়ার বিষয় রয়েছে।’
এই ঘটনা নির্বাচন কমিশনের জন্যও শিক্ষণীয় বলে মনে করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি বলেন, ‘এই নির্বাচন থেকে আমরা ভবিষ্যতে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে পারবো। আগামী নির্বাচনগুলো যেভাবে সুন্দর-সুষ্ঠুভাবে করতে পারি, তার একটি নির্দেশনা এখানে পাওয়া যাবে।’
ইউআর/