আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে একটা বদ্ধমূল ধারণা আছে, আইনজীবী (উকিল) মানেই বাই হুক ওর ত্রুক তথা যেকোনো মূল্যের বিনিময়ে স্বীয় মক্কেলকে রক্ষা করা, মোকাদ্দমায় জয়লাভ এবং কথায় কথায় মিথ্যা বলা।
এরূপ ধারণা নিতান্তই অমূলক এবং অবিবেচনা প্রসূত। একজন আইনজীবীর প্রধান এবং একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সমাজের স্বার্থে আদালতকে সহযোগিতা করা। যেকোন মূল্যের বিনিময়ে নিজের মক্কেলকে জেতানো বা অন্যের সাজা নিশ্চিত করা একজন আইনজীবীর কাজ নয়। ব্যতিক্রম দু’একটি ঘটনা ছাড়া পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে কোনো আইনজীবীকে কোটি টাকা দিয়েও একটা মিথ্যা কথা বলানো সম্ভব হবেনা। আইন পেশার মূলমন্ত্র হলো ‘এ লইয়ার ইজ এ মিনিস্টার অফ জাস্টিস’, অর্থাৎ একজন আইনজীবী ন্যায়ের মূর্ত প্রতীক। একজন আইনজীবী তার মৌখিক বাক্যে, লেখায় এবং কর্মকাণ্ডে কোন অবস্থাতেই ন্যায়বিচার ব্যাহত হতে পারে এরূপ কোনো কাজে জড়াবেন না।
মক্কেল সম্পর্কিত দায়িত্ব সমূহের মধ্যে প্রধান কাজ হচ্ছে: (১) বিচারিক বা সম্ভাব্য বিচারিক বিষয়ে মক্কেলের অভিযোগ/বিবরণ মনোযোগ সহকারে শোনা (২) বিচারিক বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত সংশ্লিষ্ট আইনের ব্যাখ্যা করা (৩) যাবতীয় প্রমাণাদি বা মামলা সংশ্লিষ্ট দালিলিক প্রমাণসমূহ পর্যালোচনা করা এবং সম্ভাব্য ও প্রয়োজনীয় প্রাসঙ্গিক তথ্য প্রমাণ সংগ্রহে পরামর্শ দেয়া (৪) আদালতের এবং মোকাদ্দমার পদ্ধতিগত নিয়মগুলো সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা (৫) সময় (তামাদি) সম্পর্কিত বিষয়ে জ্ঞাত করা (৬) মোকাদ্দমা বা সম্ভাব্য মোকাদ্দমার ক্ষেত্রে সার্বিক বিবেচনায় এবং স্বীয় বিবেক প্রয়োগ করে মামলার মেরিট তথা হার—জিত সম্পর্কে মক্কেলকে অবগত করা। উদাহরণ হতে পারে— যাবতীয় প্রমাণাদি পর্যালোচনা করে, সকল বক্তব্য শুনে এবং ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার কাছে মনে হয়েছে উক্ত (তর্কিত) সম্পত্তিতে আপনার অধিকার আছে এবং আপনি মামলায় অগ্রসর হতে পারেন অথবা আপনার অধিকার নেই এবং আপনাকে মামলা পর্যন্ত অগ্রসর না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। (৭) মোকদ্দমায় হেরে গেলে কুফল সম্পর্কে মক্কেলকে অবহিত করা (৮) মামলার পরিচালনায় খরচ এবং আইনজীবীর সম্মানি বা পারিশ্রমিক সম্পর্কে বিচারপ্রার্থীকে বিস্তারিত জানানো; (৯) পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে বর্ণনা করা (১০) মক্কেলের পক্ষে আদালতে মোকাদ্দমা পরিচালনা করা (১১) ফৌজদারি মোকদ্দমায় মক্কেল দোষ স্বীকার করলে, আনুপাতিকহারে শাস্তি বা জরিমানা হ্রাসের জন্য সংশ্লিষ্ট ফ্যাক্টরসগুলো আদালতের নজরে আনা এবং (১২) মক্কেলের জন্য আদালত এবং রাষ্ট্রের নিকট প্রাপ্য অধিকারগুলো নিশ্চিত করা।
উল্লেখিত দায়িত্বগুলো একজন আইনজীবীর শত সহস্র দায়িত্ব সূমহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মাত্র। একজন আইনজীবী সবসময় তার ধ্যানে জ্ঞানে লালন করবে তার একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। সুতরাং একজন আইনজীবী তার পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে তার কথা, কাজ বা আচরণের মাধ্যমে আদালত,পক্ষগণ এবং বিচার সংশ্লিষ্ট কাউকেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাব বিভ্রান্ত করতে পারবেন না বা ন্যায়বিচার ভুলন্ঠিত করে এমন কিছুই করতে পারেন না। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল— আইনজীবীর দায়িত্ব সমূহের মধ্যে কোথাও বলা নেই যে তাকে মক্কেলের মামলা জিততে হবে।
সাম্প্রতিক আমাদের দেশে একটি ট্রেন্ড উদ্ভূত হয়েছে। যেমন, নোয়াখালীতে ধর্ষণ ও নুসরাত হত্যা মামলায় ওসি মোয়াজ্জেমের পক্ষে অংশগ্রহণকারী আইনজীবীদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ট্রল করা হয়েছে। সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনায় ফেসবুক ট্রলের ভয়ে অভিযুক্তদের পক্ষে কোনো আইনজীবীই পাওয়া যায়নি। আমি দৃঢ়তার সাথে পরিষ্কারভাবে বলতে পারি, এই অপরাধগুলো অত্যন্ত ঘৃণ্য, মধ্যযুগীয় এবং পশুসুলভ। বিচার সাপেক্ষে এই ঘৃণ্য অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেশের সব শ্রেণি পেশার মানুষের কাম্য, আমিও এর ব্যতিক্রম নই। কিন্তু এই অপরাধীদের পক্ষে একজন আইনজীবীর অংশগ্রহণ মানেই কি যেকোনো মূল্যে তাকে (অপরাধীকে) নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য লড়া? উপরোক্ত আলোচনার আলোকে অন্তত এই কথা নির্দেশ করেনা।
আমার কাছে মনে হয় একজন আইনজীবীকে ট্রল করার আগে আমাদেরকে কিছু বিষয় মনে রাখা উচিত। যেমন-
প্রথমত: অপরাধ বিজ্ঞানে আছে, একজন অপরাধী যখন তার অপরাধ স্বীকার করে অনুশোচনায় অনুতপ্ত হয় এবং তার ভিকটিম তথা যার সাথে অন্যায় করা হয়েছে তাকে অভিহিত করে তখন ভিকটিমের মানসিক যন্ত্রণা লাগবে অনেক সহায়তা হয়। এরূপ অনুশোচনার অভিব্যক্তি অনেক সময় আদালতের শাস্তির চেয়েও ভিকটিমের নিকট বেশি স্বস্তিদায়ক হয়। একজন আইনজীবীর অংশগ্রহণ এই বিষয়ে একটা নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
দ্বিতীয়ত: একটি প্রাণ মানুষ হিসেবে জন্ম গ্রহণ করলেই কয়েকটি মৌলিক অধিকারের অধিকারী হয়। অর্থাৎ মানুষ হিসেবে জন্মের পরই থেকেই আমরা কয়েকটি মৌলিক অধিকারের দাবিদার হই এবং সেইগুলো হল খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা এবং সুবিচার। একটা মানুষ যত বড় ঘৃণ্য অপরাধেই অভিযুক্ত হোক না কেন তার এই মৌলিক অধিকারগুলো তাকে দিতে হবে। একটা মানুষ যখন কোনো ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হয় তখন আইনি সহায়তা পাওয়া তার মৌলিক অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। সুতরাং, একজন আইনজীবী ন্যায়ের মূর্তপ্রতীক হয়ে অন্যজনের মৌলিক অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হবেন এটাই স্বাভাবিক। এ ক্ষেত্রে এটা স্মরণ রাখা উচিৎ—আইনজীবীর অংশগ্রহণ মানেই যেই যেকোনো মূল্যে আসামিকে নির্দোষ প্রমাণ করা জন্য আপ্রাণ লড়া নয়। যেমন, একজন আইনজীবী আসামিকে আইন ও আদালতের পদ্ধতিগত বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারেন, তাকে দোষ স্বীকারের পরামর্শ দিতে পারেন এবং ভিকটিমের নিকট অনুশোচনার পত্র লিখতে পরামর্শ দিতে পারেন।
তৃতীয়ত: তৃতীয় কারণটি অনেকের মনঃপুত নাও হতে পারে এবং একই কারণে আমাকে নিয়েও ট্রল হতে পারে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে “দেয়ার ইজ এভরি স্কোপ টু বি সামথিং এলস বিহাইন্ড দ্যা সিন”। অর্থাৎ আমরা যেটা দেখি বাস্তবিক পক্ষে সেটা নাও হতে পারে। মিডিয়াতে এবং অভিযোগকারীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা যেটা দেখি তা পুরাপুরি সঠিক নাও হতে পারে। যেমন ধরা যাক, রিপাত শরীফ হত্যা মামলার ভিডিওতে দেখা গিয়েছিল তার স্ত্রী মিন্নি তাকে নয়ন বন্ডদের হাত রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে তিনি নিজেই এই হত্যার ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত যা অন্ততপক্ষে আদালতের রায়ে প্রতীয়মান। যদি কোনো আসামি মনে করে তার মামলায় কোনো সন্দেহজনক বিষয়ের উপস্থিতি আছে, সেই ক্ষেত্রে একজন আইনজীবীর সহায়তা ছাড়া এরূপ সত্য উদঘাটন প্রায় অসম্ভব বটে। এছাড়াও আইনের একটা স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম রয়েছে “এ পারসন ইজ প্রিজিউমড ইন্নোসেন্ট আনটিল প্রম্নভেন গিল্টি”। অর্থাৎ একজন মানুষ বিচারিক আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত হওয়া পর্যন্ত সে “অভিযুক্ত” কিন্তু অপরাধী নয়। সুতরাং, একজন আইনজীবী অভিযুক্তের পক্ষে মামলা লড়েন অপরাধীর পক্ষে নয়।
সবার প্রতি আমার পরামর্শ হলো— একজন আইনজীবীকে ট্রল করার পূর্বে উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখা উচিৎ।