দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্যে গণহত্যার চিত্র

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্ত্ব চত্বরে নতুন ভবনের সামনে অবস্থিত ভাস্কর রাসার তৈরি গুচ্ছ ভাস্কর্য। যা দেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য, ভাস্কর্যটির নাম ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’। এই ভাস্কর্যটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মরণে নিবেদিত। এতে একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি তুলে ধরা হয়েছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায় যুদ্ধের পুরো সময় এখানে সাধারণ মানুষদের ধরে এনে বিভিন্নভাবে নির্যাতন করা হতো। নির্যাতন করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা ও নারীদের। ইতিহাস বলছে এখানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয়েছে শত শত নিরপরাধ মানুষকে। হত্যার পর লাশের স্তূপ গণকবর দেওয়া হয়েছে এই কলেজ ক্যাম্পাসেই। সেই গণকবরের ওপর পরে নির্মাণ করা হয় ‘একাত্তরের গণহত্যা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’ শীর্ষক গুচ্ছ ভাস্কর্য।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ বাঙালিদের ওপর বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) নিজেই যুদ্ধের নির্মম ইতিহাসের সাক্ষি৷ সেই ইতিহাস মনে করিয়ে দিতে দাঁড়িয়ে আছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুচ্ছ ভাস্কর্য।

গুচ্ছ ভাস্কর্যটি দুটি অংশে বিভক্ত। ভাস্কর্যের পূর্ব অংশে রয়েছে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। পশ্চিম অংশে রয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম গণহত্যার চিত্র। প্রস্তুতি অংশে বাংলার কামার, কুমার, জেলে, কৃষিজীবী তথা সর্বস্তরের মানুষ স্বাধীনতার জন্য একত্র হয়েছে। দা, বঁটি, খুন্তি, কোচ, বর্শা—সবকিছু নিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন তাঁরা। পরের অংশে দেখা যায়, সবাই সামরিক প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। সেখানে রয়েছে সব বয়সী নারী ও পুরুষ। পরিপূর্ণ যুদ্ধের জন্য গেরিলা কৌশল, মাঝারি আকারের অস্ত্রের ব্যবহার শিখছেন তাঁরা।

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে সবার চোখে দেখা যায় প্রতিশোধের নেশা ভাস্কর্যে সবার মাথা সোজা রাখা হয়েছে আর মুখের রং রাখা হয়েছে লাল। লাল হলো রাগের রং। আবার অন্যদিকে গণহত্যার দৃশ্যের রং ধূসর। কারণ এটি আমাদের বেদনাদায়ক স্মৃতি। তাই বেদনার রং হিসেবে এ অংশে ধূসর রং ব্যবহার করা হয়েছে। বাকি অংশটুকু লাল আর সবুজ রঙে আবৃত যা বাংলাদেশের পতাকার রংকে ইঙ্গিত করে।

একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে এটিই বাংলাদেশের একমাত্র গুচ্ছ ভাস্কর্য। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই দেখা যায় শান্ত চত্বরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এ গুচ্ছ ভাস্কর্যটি। এটি তৈরি করেছেন খ্যাতনামা ভাস্কর রাসা। সহকারী ভাস্কর হিসেবে ছিলেন রাজিব সিদ্দিকী, রুমী সিদ্দিকী, ইব্রাহীম খলিলুর রহমান এবং মিয়া মালেক রেদোয়ান।

এই গুচ্ছ ভাস্কর্যের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৮৮ সালে। শেষ হয় ১৯৯১ সালে। ২০০৮ সালের ৩১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম খান ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক দিয়ে ঢুকলেই চোখে পড়ে ‘একাত্তরের গণহত্যা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি’ শীর্ষক গুচ্ছ ভাস্কর্য। ফলে শুধু ২৬ মার্চ বা বিজয় দিবসেই নয়। পুরো বছর এ ভাস্কর্য স্মরণ করিয়ে দেয়, নয় মাস ভীষণ কষ্ট করতে হয়েছে এ দেশের মানুষদের। স্বাধীনতার জন্য রক্ত ও সম্ভ্রম দুটোই বিলিয়ে দিতে হয়েছে অকাতরে। তারপর আমরা পেয়েছি আমাদের গৌরবের স্বাধীনতা।

ভাস্কর্যটির নিচে উভয়পাশে রয়েছে পানির ফোয়ারা। এটি দিয়ে নদীমাতৃক বাংলাদেশ বোঝানো হয়েছে। আর চারপাশে রয়েছে শিক্ষার্থীদের বসার স্থান। শিক্ষার্থীরা ক্লাস পরীক্ষা শেষে ক্লান্ত মনে এক ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে বা বসে পার করে তাদের সোনালি সময়।

- Advertisement -spot_img
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ

- Advertisement -spot_img

এই বিভাগের আরও

- Advertisement -spot_img