‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি’-প্রচলিত এই প্রবাদকেও হার মানিয়েছেন বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের (বিএমডি) সাবেক পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ। চার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি একটি ভবনের মেরামত ও সংস্কার কাজে তিনি খরচ করেছেন আট কোটি টাকা।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে ভবন সংস্কারের নামে এমন পুকুর চুরি বেরিয়ে এসেছে। এরপরই মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এই আর্থিক দুর্নীতির অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নেয়ামুল আহসান গাজীকে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। দুদকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
আরও জানা গেছে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের চাঞ্চল্যকর এই আর্থিক দুর্নীতির তথ্য পাওয়ার পর অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে রুজু করা হয়েছে বিভাগীয় মামলা। এরপর আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়ম খতিয়ে দেখাতে গত ২০ জানুয়ারি মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত প্রতিবেদন দুদকে পাঠানো হয়।
সেটি আমলে নিয়ে গঠন করা হয় অনুসন্ধান টিম। দুদক উপপরিচালক মো. সালাহউদ্দিনকে অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। কিন্তু সালাউদ্দিন আহমেদকে কিশোরগঞ্জে বদলি করায় গত ২২ জুন মোহাম্মদ নেয়ামুল আহসান গাজীকে নতুন করে অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কমিশনে চিঠি পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে উলেখ করা অভিযোগ দুদকের তফসিলভুক্ত হওয়ায় অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়েছে। বিস্তারিত অনুসন্ধান শেষে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
দুদকে পাঠানো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) দেশের একমাত্র সংস্থা হিসাবে সার্বক্ষণিক দেশের আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ. কেন্দ্রীয়ভাবে আবহাওয়ার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, আদান-প্রদান, সংরক্ষণ ও আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদান করে থাকে। আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য উপাত্ত নিয়ে সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর রিজোনাল কো-অপারেশনের (এসএএআরসি) সদস্য দেশগুলোর মধ্যে গবেষণা কাজে ২০০৫ সালে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। এটি এসএমআরসি ভবন হিসাবে পরিচিত। যে কাজে ভবনটি ব্যবহারের কথা ছিল তা হয়নি। পরে ভবনটি অধিদপ্তরের জাতীয় আবহাওয়া গবেষণা ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহারের নির্দেশনা দেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনবল বৃদ্ধি পাওয়ায় স্থান সংকুলানের লক্ষ্যে মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি শাখা/অধিশাখা এই ভবনে স্থানান্তর করা যেতে পারে বলেও মত দেওয়া হয়। নির্দেশনা বাস্তবায়নে বিএমডিকে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করে বিএমডির সাবেক পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ ভবনটি সংস্কারের উদ্যোগ নেন।
দুদকে পাঠানো মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে আরও বলা হয়, সংস্কার কাজ করার ক্ষেত্রে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নেওয়ার পর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গণপূর্ত অধিদপ্তর দ্বারা ব্যয় প্রাকলন করা প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু বিএমডির সাবেক পরিচালক প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের অধস্তন এক নির্বাহী প্রকৌশলীকে দিয়ে প্রাক্কলন প্রস্তুত করে। সংস্কার কাজের জন্য মোট ৯টি প্রাক্কলনের প্রশাসনিক অনুমোদনসহ ব্যয় মঞ্জুরি প্রদান করেন। উক্ত ৯টি প্রাক্কলনের অর্থ ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের মেরামত ও সংস্কার খাত, অনাবাসিক ভবন, বৈদ্যুতিক স্থাপনা এবং অন্যান্য ভবন ও স্থাপনা খাতের অর্থনৈতিক কোডের বাজেট বরাদ্দ থেকে ব্যয় করা হয়েছে। এই ভবনের নির্মাণ ব্যয় ছিল ৪ কোটি ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা। কিন্তু ভবনের সংস্কার কাজের প্রাক্কলিত অর্থের পরিমাণ ৮ কোটি ৭২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা, যা ভবন নির্মাণ ব্যয়ের দ্বিগুণের বেশি। এছাড়াও পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা, ২০০৮ এবং ২০১৫ সালের ডেলিগেশন অব ফিন্যান্সিয়াল পাওয়ার এর ব্যত্যয়সহ প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়ম করা হয়েছে মর্মে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে উলেখ করা হয়েছে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএমডির সাবেক পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ব্যতিরেকে ভবন সংস্কার কাজে কোটি কোটি টাকার ব্যয় মঞ্জুরি করে প্রশাসনিক ও আর্থিক অনিয়ম করেছেন। ভবনটির সংস্কার কাজে জাতীয় পর্যায়ের স্ট্যান্ডার্ড বজায় না রেখে নিজস্ব ইচ্ছা অনুযায়ী খরচ বেশি করা হয়েছে। বিএমডির সাবেক পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার প্রধান হয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর (প্রধানমন্ত্রী) সিদ্ধান্ত অমান্য, পিপিআর-২০০৮ লঙ্ঘন ও সরকারের আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আদেশ ২০১৫ লঙ্ঘন করায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা রুজু করা হয়েছে।
অভিযোগ সম্পর্কে মন্তব্য নিতে মঙ্গলবার সামছুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। এর আগে তার সহকর্মীরা জানিয়েছেন গত বছরের নভেম্বর মাসে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর তিনি (সামছুদ্দিন) কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি। তার মোবাইল নম্বরগুলোও পরিবর্তন করে ফেলেছেন।
ইউআর/