সাম্য ও মানবতায় বাঙালির সকল আবেগ, অনুভূতিতে জড়িয়ে থাকা চির বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জন্মজয়ন্তী আজ। তিনি ১৩০৬ সনের ১১জৈষ্ঠ্য জন্মগ্রহণ করেন।
করোনার এই দুর্দিনে বরাবরের মতোই তিনি বাঙালির নির্ভরতা। তবে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে চির এই বিদ্রোহী কবির রবীন্দ্রজন্মজয়ন্তীতে গেল বছরের মতো এবারও থাকছে না চিরচেনা সেই দৃশ্য। সকল জনসমাগম নিষিদ্ধ হওয়ায় আপাত দৃশ্যমান কোনো আয়োজন থাকছে না কোথাও। ভক্ত অনুরাগীরা ভিন্ন পরিবেশে তাকে আজ স্মরণ করবেন। ভার্চুয়ালি নানা আয়োজনে উদযাপন করা হবে বিদ্রোহীকবির জন্মদিন।
ছায়ানট ‘শান্তির জয় হোক’ শীর্ষক আয়োজনের মধ্য দিয়ে নজরুলের মানবতা, স্বদেশ ও উদ্দীপনামূলক গান ও কবিতা দিয়ে উদযাপন করবে কবির জন্মদিন। অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হবে আজ মঙ্গলবার, বাংলাদেশ সময় রাত ৮টায়, ছায়ানটের ফেইসবুক গ্রুপ ও ইউটিউব চ্যানেলে। এছাড়া সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ সকাল সাড়ে ৭টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে কবির সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। এছাড়াও ভোর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সংলগ্ন নজরুল সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা জানাবেন জাতীয় কবিকে।
নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে জাতীয় দৈনিকগুলো প্রকাশ করেছে বিশেষ ক্রোড়পত্র। সরকারি-বেসরকারি চ্যানেল ও রেডিওস্টেশনগুলো প্রচার করবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।
পরাধীন এক সময়ে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটেছিল নজরুলের। সেই কবেকার কথা! অথচ এই এখনো বিস্ময়কর আলো হয়ে পথ দেখিয়ে চলেছেন বাঙালিকে। ১৮৯৯ সালের আজকের দিনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কবি। নজরুল ছিলেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বাঙালি কবি, উপন্যাসিক, নাট্যকার, সঙ্গীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ ও দার্শনিক। বাংলা সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। ছোটগল্প, উপন্যাস, নাটক লিখলেও তিনি মূলত কবি হিসেবেই বেশি পরিচিত। তিনি প্রায় ৩ হাজার গান রচনা এবং বেশিরভাগই সুরারোপ করেছেন। যেগুলো নজরুলসঙ্গীত নামে পরিচিত। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। গ্রামের স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করতেন। মাত্র নয় বছর বয়সে ১৯০৮ সালে তিনি পিতৃহারা হন। অল্প বয়সেই লোকসঙ্গীত রচনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে চাষার সঙ, শকুনীবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম, রাজপুত্রের গান, বুড়ো শালিকের ঘোড়ে রোঁ এবং মেঘনাদবধ। ১৯১৭ সালের শেষভাগ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত কর্মজীবনের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদারের পদে উন্নীত হয়েছিলেন। করাচি সেনানিবাসে বসেই নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী, মুক্তি, হেনা, ব্যথার দান, মেহের নিগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি। যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু করেন। তৎকালীন বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত কবির বাঁধনহারা, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, কোরবানি, ফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম সাহিত্যকর্মগুলো ব্যাপক সমাদৃত হয়। ১৯২১ সালের অক্টোবরে তিনি শান্তি নিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
১৯২১ সালের মাঝামাঝি কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন নজরুল। আর এখানেই প্রমীলা দেবীর সঙ্গে প্রণয় থেকে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন কবি। ১৯২১ সালের ২১ নভেম্বর ভারতব্যাপী হরতাল ও অসহযোগের সময় রাজপথে নেমে আসেন কবি। ১৯২২ সালে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটির মধ্য দিয়ে সারা ভারতের সমাজে সাড়া ফেলে দেন কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২২ সালের ১২ আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ১৯২২ সালে পত্রিকাটির ৮ নভেম্বরের সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩ সালের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দি হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এক জবানবন্দি দেন। তার এ জবানবন্দি বাংলা সাহিত্যে ‘রাজবন্দির জবানবন্দি’ নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। ওই বছরের ১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। জেলে বসেই তিনি ‘আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে’ কবিতাটি রচনা করেন। মধ্যবয়সে তিনি পিকস্ ডিজিজে আক্রান্ত হন ও বাকশক্তি হারান। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়।
১৯৭২ সালে ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। এ সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। ১৯৭৬ সালে কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয় এবং তাকে ‘একুশে পদক’ দেওয়া হয়। সে বছরের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন।