ইতিহাস গড়ে সেমিতে আফগানিস্তান, বাংলাদেশের বিদায়

সমীকরণ একদম সহজ। বাংলাদেশকে যেকোনো ব্যবধানে হারালেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে উঠে যাবে আফগানিস্তান। এমন ম্যাচে খেলতে নেমে আগে ব্যাট করে ২০ ওভারে ৫ উইকেট হারিয়ে ১১৫ রান করে আফগানরা। ডিএলএস মেথডে জয়ের জন্য টাইগারদের লক্ষ্য দাঁড়িয়েছিল ১৯ ওভারে ১১৪ রান। টাইগারদের হারিয়ে শেষ চারে জায়গা নিশ্চিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে রশিদ খানের দল। এরই ধারাবাহিকতায় শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে লাল-সবুজের দলকে হারিয়ে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করেছে আফগানিস্তান।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার এইটের শেষ ম্যাচে সেন্ট ভিনসেন্টে বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার সকালে ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন পদ্ধতিতে বাংলাদেশকে ৮ রানে হারায় আফগানিস্তান। ১৬ বছর আগেও যে দেশটি খেলত আইসিসি ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড ডিভিশন ফাইভ-এ, সেই দলটিই চমকপ্রদ পথচলায় এখন বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালে।

আর্নস ভেল স্টেডিয়ামে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নামা আফগানিস্তানকে আবারও ভিত গড়ে দেন দুই ওপেনার রাহমানউল্লাহ গুরবাজ ও ইব্রাহিম জাদরান। তবে এরপর খুব একটা ভালো করতে পারেনি তারা। শেষ দিকে রাশিদ খানের তিন ছক্কার ক্যামিও দলকে এনে দেয় ১১৫ রানের পুঁজি।

সেমি-ফাইনালে যেতে হলে এই রান ১২.১ ওভারে টপকাতে হতো বাংলাদেশকে। লিটন কুমার দাসের ব্যাটে সেই সম্ভাবনাও জেগে ওঠে। কিন্তু সময় যত গড়ায়, সেই সম্ভাবনাও দূরে সরতে থাকে।

খেলাটা যখন স্রেফ ১২.১ ওভারের, বিস্ময়করভাবে দলের সাম্প্রতিক সময়ের সেরা ব্যাটসম্যান তাওহিদ হৃদয়কে ছয় নম্বরে নামায় বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট। ওপেনিংয়ে তানজিদ হাসান ব্যর্থ হন আবারও। নাজমুল হোসেন শান্ত মেটাতে পারেননি সময়ের দাবি। সাকিব আল হাসান বিদায় নেন প্রথম বলেই, একাদশে ফেরা সৌম্য সরকারও ব্যর্থ।

নিজেদের সেমি-ফাইনাল স্বপ্ন ভেস্তে যাওয়ার পর অস্ট্রেলিয়ার আশার তরী বয়ে নিচ্ছিল বাংলাদেশ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ব্যর্থ সেখানেও।

কয়েক দফা বৃষ্টির পর ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন পদ্ধতিতে বাংলাদেশর লক্ষ্য নির্ধারিত হয় ১৯ ওভারে ১১৪। তারা গুটিয়ে যায় ১০৫ রানে।

ব্যাট হাতে ক্যামিও ইনিংসের পর বল হাতেও চার উইকেট নিয়ে সামনে থেকে নেতুত্ব দেন রাশিদ খান। নতুন বলে দুই উইকেটের পর শেষ দিকে দুই উইকেট নিয়ে ম্যাচের সেরা নাভিন-উল-হক।

টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে আফগানিস্তানের দুই ওপেনার বুঝে যান, এই উইকেটে স্ট্রোক খেলা কঠিন। তাই উইকেটে আগলে রেখে রানিং বিটুইন দা উইকেটে জোর দিয়ে রান করার পথ বেছে নেন দুজন।

পাওয়ার প্লেতে দুই ব্যাটসম্যান বাউন্ডারি মারতে পারেন স্রেফ একটি করে। আফগানিস্তান রান তোলে ২৭।

নতুন বলে তানজিম হাসান ও তাসকিন আহমেদ ভালো বোলিং করলেও আরেকটি স্টাম্প সোজা ও আরও একটু ফুল লেংথ বোলিং না করার দায় কিছুটা দেওয়াই যায় তাদের।
এর মধ্যে একটি সুযোগও আসে। পঞ্চম ওভারে সাকিব আল হাসানের বলে ইব্রাহিম জাদরানের কঠিন একটি ক্যাচ শর্ট কাভারে নিতে পারেননি তাওহিদ হৃদয়। সেই সাকিবকেই পরে বিশাল একটি ছক্কা মারেন গুরবাজ।

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ের ম্যাচে এই মাঠেই প্রথম ১০ ওভারে ৬৪ রান তুলে পরে রানের গতি বাড়িয়েছিল আফগানরা। এই ম্যাচেও তারা একই কৌশল নেয়। প্রথম ১০ ওভারে রান আসে ৫৮।

তবে পরের ১০ ওভারে এ দিন আর প্রত্যাশিত সেই গতি তারা পায়নি।

৫৯ রানের উদ্বোধনী জুটি ভাঙে একাদশ ওভারে। রিশাদ হোসেনকে উড়িয়ে মেরে জাদরান আউট হন ২৯ বলে ১৮ রান করে।

আফগানদের রানে গতি এরপর কমে যায় আরও। রিশাদের এক ওভারে দুটি বাউন্ডারি মেরে গতি বদলানোর আভাস দেন গুরবাজ। কিন্তু নিজের পরের ওভারেই জোড়া উইকেট নিয়ে জবাব দেন রিশাদ। ৫৫ বলে ৪৩ করা গুরবাজ ধরা পড়েন সৌম্যর হাতে। দুই বল পরই সৌম্যর দারুণ ক্যাচে ফেরেন গুলবাদিন নাইব।

এর আগেই আজমাতউল্লাহ ওমারজাইকে ফেরান মুস্তাফিজুর রহমান। তাসকিনের বলে বারবার ব্যাটে লাগাতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত মোহাম্মদ নাবি ফেরেন ১ রানে।

কিন্তু শেষ সময়টায় নিজের হাতে জোর দেখান রাশিদ খান। দুই ওভার মিলিয়ে টানা ১১টি বলে রান না দেওয়া তাসকিনকে শেষ বলে গ্যালারিতে আছড়ে ফেলেন আফগান অধিনায়। শেষ ওভারে দুটি ছক্কা মারেন তিনি তানজিমকে। স্ট্রাইক না পেয়ে এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে সতীর্থ কারিম জানাতের দিকে ব্যাট ছুড়েও মারেন অধিনায়ক।

তবে ১০ বল ১৯ রানের যে ইনিংসটি তিনি খেলেন, তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস হয়তো এটিই।

ইনিংস বিরতিতে বৃষ্টিতে উইকেট সহজ হয়ে আসে কিছুটা। বল ব্যাটে আসতে থাকে ভালোভাবে। বাংলাদেশের রান তাড়ার শুরুটাও হয় ইতিবাচক। নাভিন-উল-হাকের প্রথম ওভারে ব্যাটের কানায় লেগে চার পাওয়ার পর ৯১ মিচার লম্বা ছক্কা মারেন লিটন কুমার দাস।

তবে দ্বিতীয় ওভারেই তানজিদ হাসানকে শূন্য রানে ফেরান ফাজালহাক ফারুকি। এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ডে তিনি (১৬) স্পর্শ করেন ওয়ানিন্দু হাসারাঙ্গাকে।

পরের ওভারে বাংলাদেশকে জোড়া ধাক্কা দেন নাভিন। একটি চারের পর ছক্কার চেষ্টায় সীমানায় ধরা পড়েন নাজমুল হোসেন শান্ত। প্রথম বলেই বোলারকে ফিরতি ক্যাচ দেন সাকিব আল হাসান।

চতুর্থ ওভারে আরেক দফা বৃষ্টিতে বন্ধ থাকে খেলা। পরে বাংলাদেশ পাওয়ার প্লে শেষ করে ৪৬ রান তুলে।

পাওয়ার প্লে শেষে রাশিদ আক্রমণে এসে জোরের ওপর করা ডেলিভারিতে বোল্ড করেন সৌম্য সরকারকে (১০ বলে ১০)।

ছয়ে নেমে হৃদয় দুটি চার মারেন মোহাম্মদ নাবিকে। কিন্তু তাকেও থামিয়ে দেন রাশিদ।

লিটন তবু চেষ্টা করে যান। রাশিদের ওই ওভারে তিনি আদায় করেন তিনি বাউন্ডারি। কিন্তু আরেকপ্রান্তে উল্টো চিত্র। নূর আহমাদকে একটি বাউন্ডারি মারলেও ওভারের বাকি ৫ বলে রানই করতে পারলেন না মাহমুদউল্লাহ। পরের ওভারে টানা দুই বলে মাহমুদউল্লাহ ও রিশাদকে ফিরিয়ে আফগানিস্তানকেও দারুণভাবে ম্যাচে ফেরান রাশিদ।

বৃষ্টিতে এরপর আরেক দফায় বন্ধ হয় খেলা। ওভার কমে যায় একটি, লক্ষ্য কমে যায় দুই রান। লিটন ও তানজিম বেছে নেন ধীর পায়ে এগোনোর পথ। কিছুক্ষণ ক্রিজে কাটিয়ে তানজিম উইকেট উপহার দেন গুলবাদিন নাইবকে।

লিটন তবু ছিলেন দলের আশা হয়ে। ১৭ ইনিংস পর ফিফটির দেখা পান তিনি। কিন্তু আরেকপ্রান্তে পাননি উপযুক্ত সঙ্গী। বৃষ্টির আগে পরে টানা দুই বলে তাসকিন ও মুস্তাফিজকে ফিরিয়ে দলকে স্বপ্নের ঠিকানায় নিয়ে যান নাভিন। বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ‘ক্যারিং দা ব্যাট থ্রু আউট আ কমপ্লিটেড ইনিংস’-এর নজির গড়েও হতাশায় মাঠ ছাড়েন লিটন।

প্রথম সেমি-ফাইনালে ত্রিনিদাদে দক্ষিণ আফ্রিকার মুখোমুখি হবে আফগানিস্তান, আরেক সেমি-ফাইনালে ভারতের প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:

আফগানিস্তান: ২০ ওভারে ১১৫/৫ (গুরবাজ ৪৩, জাদরান ১৮, ওমারজাই ১০, নাইব ৪, নাবি ১, জানাত ৭*, রাশিদ ১৯*; তানজিম ৪-০-৩৬-০, তাসকিন ৪-১-১২-১, সাকিব ৪-০-১৯-০, মুস্তাফিজ ৪-০-১৭-১, রিশাদ ৪-০-২৬-৩)।

বাংলাদেশ: (লক্ষ্য ১৯ ওভারে ১১৪) ১৭.৫ ওভারে ১০৫ (লিটন ৫৪*, তানজিদ ০, শান্ত ৫, সাকিব ০, সৌম্য ১০, হৃদয় ১৪, মাহমুদউল্লাহ ৬, রিশাদ ০, তানজিম ৩, তাসকিন ২, মুস্তাফিজ ০; নাভিন ৩.৫-০-২৬-৪, ফারুকি ২-০-১৫-১, নাবি ২-০-১৫-০, রাশিদ ৪-০-২৩-৪, নুর ৪-০-১৩-০, নাইব ২-০-৫-১)

ফল: ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন পদ্ধতিতে আফগানিস্তান ৮ রানে জয়ী।

ম্যান অব দা ম্যাচ:  নাভিন-উল-হাক।

- Advertisement -spot_img
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ

- Advertisement -spot_img

এই বিভাগের আরও

- Advertisement -spot_img