সংযুক্ত আরব আমিরাতে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নেই বললেই চলে। ভারতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক দাপট থাকলেও সেখানে অবহেলিত বাংলা ভাষা চর্চা। বাংলা ভাষাভাষী শিক্ষার্থীদের বাংলার সাথে যোগসুত্র ধরে রাখতে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ কয়েকযুগ ধরে চেষ্ঠা করে যাচ্ছেন এমন কিছু শিক্ষক যারা রয়ে গেছেন একেবারে পর্দার আড়ালে। যাদের সংখ্যা একেবারে হাতেগোনার মত। এবার ভাষার মাসে আরব আমিরাতের এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলার পাঠ্যবই পাঠদান করেন এমন সাবেক ও বর্তমান ১০ জন বাংলাদেশি শিক্ষককে সম্মাননা প্রদান করেছে বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব ইউএই।
গত রবিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে মহান আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ প্রেস ক্লাব ইউএই’র উদ্যোগে আরব আমিরাতের শারজায় আয়োজিত ‘মায়ের ভাষায় কথা বলি’ অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মত আমিরাতের বিভিন্ন প্রদেশে অবস্থিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাবেক ও বর্তমান বাংলার শিক্ষকদের সম্মাননা প্রদানের এই ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এছাড়া অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের আট বিভাগের আটজন বক্তা নিজ নিজ আঞ্চলিক ভাষায় নিজ এলাকাকে প্রাণবন্তভাবে তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে ছিল কবিতা আবৃত্তি পর্বও।
বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের সভাপতি শিবলি আল সাদিকের সভাপতিত্বে
ও সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান জনির সঞ্চালনায় ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুবাই ও উত্তর আমিরাত বাংলাদেশ কনস্যুলেটের কনসাল জেনারেল বিএম জামাল হোসেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন পরিবেশ ও প্রাণীবিজ্ঞানী ড. আলী রেজা খান, বাংলাদেশ কনস্যুলেটের প্রথম সচিব (প্রেস) আরিফুর রহমান, শারজা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আহমেদ হোসাইন, বাংলাদেশ সমিতি দুবাইয়ের সিনিয়র সহ সভাপতি ইয়াকুব সৈনিক, বাংলাদেশ সমিতি শারজার সহ সভাপতি মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন প্রমুখ। এসময় শারজাহ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ শিক্ষা বোর্ড ও সিবিএসই বোর্ডের অধিনস্থ ১১ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক এবং বাংলাদেশ প্রেসক্লাবের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে ১০ জন বাংলাদেশি শিক্ষককে সম্মানিত করা হয়েছে। যারা দেশটিতে সর্বনিন্ম ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩৬ বছর পর্যন্ত বাংলাদেশ শিক্ষা বোর্ড ও সিবিএসই বোর্ডের অধীনস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা বিষয়ে পাঠদান করে আসছেন। অনুষ্ঠানে শিক্ষকদের হাতে এই সম্মাননা তুলে দেন অতিথিরা। সম্মাননা প্রাপ্তরা হলেন- অধ্যাপিকা নুরুন নাহার হুদা, রহিমা ইসলাম, সুমনা দাস, অধ্যাপক এস এম আবু তাহের, আবু তাহের মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ, নাসরীন সুলতানা, শেখ কানিজ-এ-ফেরদৌস, রহিমা সেলিনা সিদ্দিকী, স্নিগ্ধা সরকার তিথী ও জুইঁয়েনা আক্তার।
আমিরাতে ৩০ বছর বাংলা বিষয়ে শিক্ষকতা শেষে অবসর যাওয়া অধ্যাপিকা নুরুন নাহার হুদা এই সম্মাননা পেয়ে আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাতে নতুন এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হলো। এই প্রথম শিক্ষকরা একই মঞ্চে দাঁড়ানোর সুযোগ হলো। এর আগে কোন সামাজিক, রাজনৈতিক বা সেবামূলক সংগঠন বাংলাদেশি শিক্ষকদের আলাদাভাবে সম্মান জানায়নি। এই ভালোবাসা আমাদের কাছে অনেক মূল্যবান।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে কনসাল জেনারেল বিএম জামাল হোসেন বলেন, ‘মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করা জাতির কাছে ভাষা গুরুত্বপূর্ণ হওয়াটাই স্বাভাবিক। আর এই ভাষা দূরপরবাসে বেড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের কাছে যারা পৌঁছে দিচ্ছেন তাদের সম্মান জানিয়ে বাংলাদেশ প্রেসক্লাব একটি মহৎ কাজ করেছে৷ তা ছাড়া আঞ্চলিক ভাষায় যে বৈচিত্রতা তারা তুলে ধরেছে এটিও প্রশংসনীয় কাজ।’ এসময় তিনি বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও প্রবাসীদের দুবাই ও উত্তর আমিরাতে আন্তর্জাতিক মানের একটি বাংলাদেশি স্কুল প্রতিষ্ঠা ও শিশুকিশোরদের জন্য বাংলা ভাষা চর্চা কেন্দ্র চালু করতে বাস্তবমুখী ও সাহসী উদ্যোগ গ্রহণের আহবান জানান।
এরআগে অনুষ্ঠানে বাংলা ভাষা চর্চায় উৎসাহিত করতে ও আঞ্চলিক ভাষার মর্যাদা রক্ষায় একটি বিশেষ পর্ব পরিচালনা করায়। যেখানে দেশের আটটি বিভাগের আঞ্চলিক ভাষাসহ প্রায় বিলুপ্ত উপভাষায় নিজ অঞ্চলের ভাষার বৈচিত্র্য ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন প্রবাসীরা। এতে ঢাকার কুট্টি ভাষায় রেজা খান, চাটগাঁইয়া ভাষায় মোস্তফা মাহমুদ, সিলেটি ভাষায় হাজী শফিকুল ইসলাম, রংপুরী ভাষায় স্নিগ্ধা সরকার তিথী, মোমেনশিঙ্গা ভাষায় উত্তম কুমার সরকার, বরিশাইল্যা ভাষায় সাথী আক্তার প্রিয়া, খুলনাইয়া ভাষায় শাহীদ ইসলাম, বরেন্দ্রী উপভাষায় সানজিদা আঞ্জুম শিমুল ও নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় কামাল হোসাইন সুমন নিজের অঞ্চলকে তুলে ধরেন। এ ছাড়া অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন জামাল হোসেন, আবিদা হোসেন, শিবলী আল সাদিক, এস এম শাফায়েত, রাহবার আবদুল্লাহ শিবলী, রুহিন হোসেন ও সাকিয়া সিদ্দিকা জেরিন।