আগের মেয়রদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে গত ১০ বছরে গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকার নাগরিক সমস্যার সমাধান হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী আজমত উল্লা খান। তিনি বলেন, গাজীপুরে অনেক সমস্যা রয়েছে। বর্তমান সরকার গাজীপুর সিটির উন্নয়নে বহু সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা, সততা ও স্বচ্ছতার অভাবে সমস্যাগুলোর সমাধান হয়নি।
আজ রোববার গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকার প্রকৌশলী ভবন মিলনায়তনে নিজের নির্বাচনী ইশতেহার তুলে ধরেন আজমত উল্লা খান। সেখানে মেয়র নির্বাচিত হলে কী কী উন্নয়ন করবেন, তার ফিরিস্তি তুলে ধরার পাশাপাশি আগের মেয়রদের কাজেরও সমালোচনা করেন তিনি। তবে আজমত উল্লা খান ইশতেহারে বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তার অনেকটি সিটি করপোরেশনের মেয়রের এখতিয়ারের বাইরে। ২৫ মে গাজীপুরে ভোট গ্রহণ হবে।
আজমত উল্লা খান মেয়র নির্বাচিত হলে সিটি করপোরেশনের উন্নয়নে এক, দুই ও পাঁচ বছর মেয়াদি তিনস্তরবিশিষ্ট পরিকল্পনা নেবেন বলে ইশতেহারে উল্লেখ করেছেন। প্রশাসনের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, সিটি মাস্টারপ্ল্যান এবং জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। সিটি করপোরেশনের জন্য যে ২৮ ধরনের পদক্ষেপ নেবেন, সেগুলো নির্বাচনী ইশতেহারে তুলে ধরেন।
প্রশ্নোত্তর পর্বে আজমত উল্লা বলেন, ২০১৩ সালে যাত্রা শুরু হলেও গত ১০ বছরে গাজীপুর সিটি করপোরেশনবাসী সেবা পায়নি। সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব ছিল। মেয়রদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়টি দুদক, উচ্চ আদালত পর্যন্ত গেছে। ১০ বছরেও সিটি করপোরেশনের একটা অর্গানোগ্রাম হয়নি। হিংসা, বিদ্বেষ ও সংকীর্ণ মানসিকতা মুক্ত থেকে গাজীপুরকে আধুনিক নগরে রূপান্তর করাই তাঁর লক্ষ্য।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে পরামর্শক কমিটি বা নগর উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি গঠন করবেন আজমত উল্লা। তাঁদের পরামর্শ ও সুপারিশের ভিত্তিতে সিটি করপোরেশনের উন্নয়নমূলক প্রকল্প প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তিনি।
অভিজ্ঞ নগরবিদ ও প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে একটি মহাপরিকল্পনা (মাস্টারপ্ল্যান) তৈরি করে সেবা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। গৃহকর, ট্রেড লাইসেন্স, নাগরিক সনদসহ বিভিন্ন সনদের ফি ও বিল অনলাইনে পরিশোধের ব্যবস্থা এবং ওয়ার্ডগুলোকে সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা ও ফ্রি ওয়াই-ফাই জোন করার উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলেন তিনি।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকার বড় সমস্যা যানজট। এই সমস্যা নিরসনে বেশ কিছু কার্যক্রম নেওয়ার কথা জানিয়েছেন আজমত উল্লা। এর মধ্যে রয়েছে—পথচারীবান্ধব ও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন মানুষের জন্য ফুটপাথ তৈরি, ব্যস্ততম এলাকায় বহুতল ও আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং কমপ্লেক্স নির্মাণ, নতুন পদচারী–সেতু, আধুনিক বাসস্ট্যান্ড ও বাস-ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ এবং নাগরিকদের রেলে যাতায়াত সহজ করা। জয়দেবপুর রেলক্রসিংয়ের ওপর উড়ালসড়ক নির্মাণসহ গাজীপুরে সংযোগ সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার কথাও বলেছেন তিনি।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন এলাকায় শ্রমজীবী মানুষের বসবাস বেশি। বিশেষ করে, পোশাক কারখানার। তাঁদের জন্যও বেশ কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আজমত উল্লা। এর মধ্যে শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণে নিয়মিত মনিটরিং, শ্রমজীবী মায়েদের শিশুদের জন্য প্রতি ওয়ার্ডে ডে কেয়ার সেন্টার প্রতিষ্ঠা, বিকেল পাঁচটার পরও টিসিবির খাদ্যসামগ্রী পাওয়ার উদ্যোগ, বেতন-ভাতা, বাসস্থান ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সহায়তা দেওয়ার বিষয় অন্যতম। গাজীপুর মহানগরীর বস্তিবাসীদের নাগরিক সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করার কথাও বলেছেন আজমত উল্লা। তিনি উল্লেখ করেন, শ্রমিক, বস্তিবাসী ও দরিদ্র মানুষের জন্য বিনা মূল্যে স্বাস্থ্য কার্ড দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।
নির্বাচিত হলে গৃহকরের হার না বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী। মহানগর ও ওয়ার্ডভিত্তিক সমস্যা সমাধানের ‘জনতার মুখোমুখি’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। শিল্পমালিক ও ব্যবসায়ীদের ভোগান্তি কমাতে সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে হেল্প ডেক্স তৈরি এবং গাজীপুর মহানগরীতে বিভিন্ন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আজমত উল্লা।
বর্জ্য পরিশোধন কেন্দ্র স্থাপন, প্রতিটি ওয়ার্ডে বর্জ্য সংরক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রসারে নতুন অডিটরিয়াম এবং কালচারাল কমপ্লেক্স, মুক্তমঞ্চ নির্মাণ, খেলার জন্য উপযুক্ত মাঠ তৈরি করা, পার্ক ও উদ্যানগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার ও উন্নয়ন করা, প্রতিটি ওয়ার্ডে ঈদগাহ ও কবরস্থান নির্মাণ, নদীসংলগ্ন স্থানকে নান্দনিক, পায়ে হাঁটা ও বিনোদন উপযোগী করার পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী।
আজমত উল্লা তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে নদী ও জলাশয়কে দখলমুক্ত, দূষণমুক্ত ও সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া, নগরীতে বৃক্ষরোপণ, কাঁচাবাজার ও মার্কেটের আধুনিকায়ন, হকারদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থান, ফ্রাইডে মার্কেট স্থাপন, পরিবেশবান্ধব আধুনিক কসাইখানা ও পর্যাপ্ত আধুনিক পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করার কথা বলেছেন।
আজমত উল্লার এসব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের গাজীপুর শাখার সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার শিশির বলেন, অঙ্গীকারের সঙ্গে বাস্তবায়নের বড় সমস্যা হবে সামর্থ্য নিয়ে।
সিটি করপোরেশনের নাগরিকদের সেবার মাত্র ৩৫ শতাংশ সেবা সিটি করপোরেশনের সক্ষমতায় আছে। বাকি সেবা প্রদান করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে হলে সিটি করপোরেশন এবং মেয়রের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, না হলে এই ইশতেহার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।
ইশতেহার ঘোষণার সময় আজমত উল্লার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি আলিম উদ্দিন, রিপন সরকার, ওয়াজ উদ্দিন, গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউল্লাহ মণ্ডল, সাবেক সদস্য আবদুল হাদী শামিম, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আহমদ ও মজিবুর রহমান প্রমুখ।