মানুষ ভোট দিতে পারবেন কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন

‘ভোটার হব নিয়ম মেনে, ভোট দিব যোগ্যজনে’—এটা জাতীয় ভোটার দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য। যদিও ভোটার হওয়ার পর মানুষ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবেন কি না, সেটা এখনো বড় প্রশ্ন হয়ে রয়েছে। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) এক বছর পার করেছে। আর ১০ মাস পর জাতীয় নির্বাচন, সে নির্বাচন নিয়ে এখন পর্যন্ত আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি ইসি। এমন একটা পরিস্থিতিতে আজ ২ মার্চ জাতীয় ভোটার দিবস পালন করছে ইসি।

দেশে স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ নিয়ে অনিশ্চয়তা বা শঙ্কার বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দেয় ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে। ওই নির্বাচনে ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দলটির জোটসঙ্গীরা। এরপর ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটের দিনের আগের রাতেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয় বলে অভিযোগ আছে। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রভাব পড়ে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন ভোটেও। এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয় যে ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাওয়া মানেই নির্বাচনে জয় অনেকটা নিশ্চিত।

আগামী নির্বাচনে সব ভোটার নিজের পছন্দে ভোটাধিকার

প্রয়োগ করতে পারবেন কি না, তা নির্ভর করবে সরকার ইসিকে

কতটুকু কী করতে দেবে এবং কমিশন কতটুকু দৃঢ়তা দেখাতে পারবে, তার ওপর।
এম সাখাওয়াত হোসেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার

সাবেক নির্বাচন কমিশনার (এখন প্রয়াত) মাহবুব তালুকদারের ভাষায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল ব্যর্থতার গ্লানি। গত এক দশকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর বেশির ভাগ নিয়ে ছিল নানা ধরনের প্রশ্ন। ভোটে সংঘর্ষ ও প্রাণহানি, কেন্দ্র দখল, ভোটারদের ভোট দিতে বাধা দেওয়া, প্রকাশ্যে ভোটারদের হুমকি, গোপন বুথে অবৈধভাবে অবস্থান নিয়ে ইভিএমের বোতাম চেপে দেওয়া, প্রতিপক্ষের এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়াসহ নানা অনিয়ম ছিল নির্বাচনের সঙ্গী। একপর্যায়ে ভোটারবিমুখতাও দেখা দেয় বিভিন্ন নির্বাচনে।

বর্তমান কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতেও ভোট পড়ার হার তুলনামূলক কম, প্রতিদ্বন্দ্বিতাও সেভাবে দেখা যায়নি। অবশ্য ক্ষমতাসীনদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি এসব নির্বাচন বর্জন করেছে। সর্বশেষ ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়ার গড় হার ছিল ২৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের (ফেমা) প্রধান মুনিরা খান প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত নির্বাচনকেন্দ্রিক যেসব কর্মকাণ্ড, তা হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। ভোটারদের নিয়ে কোনো কর্মসূচি দেখা যায়নি। বিভিন্ন নির্বাচনে ভোট পড়ার হার কমে যাচ্ছে। এতে বোঝা যায়, ভোটের প্রতি মানুষের অনীহা আছে। সাম্প্রতিক সময়ের উপনির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ভোটের হার দেখে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরাও সবাই ভোট দিতে যাচ্ছেন না। এই অনীহা কেন, তা খুঁজে বের করতে হবে।

তাঁরা আশা করেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা থাকবে। সে লক্ষ্যে তাঁরা কাজ করছেন। তাঁর দাবি, তাঁরা এ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন করেছেন, সব নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়েছে। ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি, এমন ঘটনা ঘটেনি। এতে মানুষের আস্থা অনেক বেড়েছে।
রাশেদা সুলতানা, নির্বাচন কমিশনার

আগের দুই কমিশনের মতো কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের অধীনে প্রথম বড় নির্বাচন ছিল কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন। গত জুনে কুমিল্লার নির্বাচনে ভোট গ্রহণ সুষ্ঠু হলেও ভোটের আগে-পরে ছিল নানা বিতর্ক। এই নির্বাচনের প্রচারের সময় ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে এলাকা ছাড়তে বলেছিল ইসি। কিন্তু তিনি না মানেননি, বরং ইসির এখতিয়ার নিয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন। পরে পিছু হটে ইসি।

কুমিল্লার পর গত বছরের ডিসেম্বরে রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু হয়। এর বাইরে এখন পর্যন্ত বর্তমান কমিশন বেশ কিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং জাতীয় সংসদের কয়েকটি আসনের উপনির্বাচন করেছে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের আপত্তি সত্ত্বেও বর্তমান কমিশন প্রায় সব নির্বাচনেই ইভিএম ব্যবহার করছে।

নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা আশা করেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা থাকবে। সে লক্ষ্যে তাঁরা কাজ করছেন। তাঁর দাবি, তাঁরা এ পর্যন্ত যতগুলো নির্বাচন করেছেন, সব নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু হয়েছে। ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি, এমন ঘটনা ঘটেনি। এতে মানুষের আস্থা অনেক বেড়েছে।

ইভিএমে জোর, সিসিটিভি নিয়ে সংশয়

বর্তমান কমিশন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের যে কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেছে, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে ১৪টি বাধা চিহ্নিত করা হয়। তার একটি হচ্ছে ভোটারদের পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করা। আরেকটি হচ্ছে জাল ভোট, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই রোধ করা।

কমিশন মনে করে, কাগজের ব্যালটে ভোট হলে কেন্দ্র দখল করে ভোটের আগে-পরে ইচ্ছেমতো বাক্সে ব্যালট ভর্তি করা সম্ভব। কিন্তু ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হলে এমন জালিয়াতি করা সম্ভব নয়। এ জন্য তারা সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে এই যন্ত্রে ভোট নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে অর্থনৈতিক সংকটে নতুন ইভিএম কেনা সম্ভব হচ্ছে না বিধায় এই সিদ্ধান্ত অনিশ্চয়তার মুখে আছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইভিএম নিয়ে বেশির ভাগ দলের আপত্তি আছে। ভোটারদের অনেকে ইভিএমে স্বচ্ছন্দ নন। তারপরও ইসি এই যন্ত্র ব্যবহারে অনড়। তারা যে যুক্তি দিচ্ছে তাতে প্রশ্ন জাগে, কমিশন কি আগেই ধরে নিয়েছে যে তারা ভোটকেন্দ্রগুলোতে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে না?

কমিশন বাধা উত্তরণে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের কথা বলেছিল। কয়েকটি স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনে সিসিটিভি ব্যবহার করে ‘গোপন বুথে ডাকাত’ ধরে ইসি। সিসিটিভিতে ব্যাপক অনিয়ম দেখে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছিল ইসি। এটি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের কেউ কেউ সমালোচনা করেন। পরে গত ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে অর্থসংস্থানের অভাবের কথা বলে সিসিটিভি ব্যবহার করা হয়নি। ইসি বলছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে ৩০০ আসনের সব ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে।

মাঠে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সংশয়
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঠপর্যায়ে ইসির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা অপরিহার্য। কারণ, মাঠপর্যায়ে প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তারাই মূলত নির্বাচন পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকেন। কিন্তু এক দশক ধরে মাঠপর্যায়ে ইসির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশ্ন আছে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার (প্রয়াত) মাহবুব তালুকদারের লেখা সদ্য প্রকাশিত নির্বাচননামা বইয়েও এ কথা এসেছে। তাঁর সময়ে কয়েকটি সিটি করপোরেশন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে তিনি লিখেছেন, ‘সামগ্রিক পর্যালোচনায় আমার কাছে মনে হয়েছে, নির্বাচনের নিয়ন্ত্রণ কমিশনের হাত থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে হস্তান্তরিত হয়ে গেছে।’

বর্তমান কমিশন মাঠপর্যায়ে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। গত বছরের অক্টোবরে সব জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি) ঢাকায় ডেকেছিল ইসি। ওই বৈঠকে ডিসিদের নিরপেক্ষতা ও আর্থিক সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বক্তব্য দিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান। তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদে ডিসিরা হইচই করেছিলেন। এমনকি তাঁরা আনিছুর রহমানের বক্তব্য শুনতেও রাজি ছিলেন না। যে কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি আর বক্তব্যই দেননি। তখনই প্রশ্ন উঠেছিল, ইসি কি ভোটের সময় ডিসিদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে?

বিব্রতকর ঘটনাটির মাত্র তিন দিন পর ১২ অক্টোবর ছিল গাইবান্ধা-৫ আসনে উপনির্বাচন। সেখানে ভোটের গোপনীয়তা রক্ষা করা যায়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে পুরো উপনির্বাচনই বন্ধ করে দেয় ইসি। ভোটের দিনের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সঙ্গে টেলিফোনে তিনি কথা বলেছেন। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।

পরবর্তী সময়ে এই আসনে ভোটের অনিয়মে ১৩৪ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। কিন্তু ডিসি, এসপিদের কোনো অনিয়ম তদন্তে ধরা পড়েনি। তাঁদের বিষয়ে কোনো সুপারিশও করা হয়নি। এমনকি কোন প্রার্থীর জন্য এই ব্যাপক অনিয়ম করা হয়েছিল, তা-ও ইসির তদন্তে বলা হয়নি। গত ১ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোটের আগে ‘নিখোঁজ’ হন। কিন্তু এ বিষয়ে ইসির পক্ষ থেকে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা দেখা যায়নি।

অবশ্য ভোটের মাঠে ইসির নিয়ন্ত্রণ নেই, এটি মানতে নারাজ ইসি। গত ১ ফেব্রুয়ারি ছয় আসনে উপনির্বাচন শেষে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে তাঁরা যে সহায়তা পাচ্ছেন, তা নির্ভরযোগ্য, তাতে তাঁরা সন্তুষ্ট।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, আগামী নির্বাচনে সব ভোটার নিজের পছন্দ অনুযায়ী ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন কি না, তা নির্ভর করবে সরকার ইসিকে কতটুকু কী করতে দেবে এবং কমিশন কতটুকু দৃঢ়তা দেখাতে পারবে, তার ওপর। তবে বর্তমান কমিশনের দৃঢ়তা নিয়ে মাঝেমধ্যে শঙ্কা হয়। এখন পর্যন্ত তারা যা করেছে, তাতে দৃঢ়তার ছাপ দেখা যায়নি। অর্ধেকটা গিয়ে তারা আর এগোতে পারছে না। তিনি বলেন, ভোটার দিবস পালন ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এই উৎসবের মধ্যে ইসিকে প্রত্যয় নিতে হবে তাদের যতখানি শক্তি আছে, তা দিয়ে ভোটারদের ভোটাধিকার প্রয়োগের ব্যবস্থা নেবে।

- Advertisement -spot_img
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ

- Advertisement -spot_img

এই বিভাগের আরও

- Advertisement -spot_img