ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকেই জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা করছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তদন্ত কমিটি।
প্রাথমিক তদন্তে কমিটি জানতে পেরেছে এখানকার সঞ্চালন লাইনের কোনো একটি ইন্টারকানেকশনের মধ্যে ত্রুটির কারণে এই ঘটনা ঘটতে পারে।
অর্থাৎ বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো একটি লাইন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অন্য লাইন ওভার লোড হয়ে সেটা ট্রিপ করে। এ কারণে পূর্বাঞ্চলের গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বল্পতা দেখা দেয়। কমিটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইনের বেশকিছু ডেটা সংগ্রহ করেছে। সিরাজগঞ্জ ও ঈশ্বরদী বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের ডেটাও সংগ্রহ করবে।
এরপর সবকিছু হিসাবনিকাশ করে বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। এজন্য ৩ থেকে ৪ দিন সময় লাগতে পারে বলে জানা গেছে।
বুধবার সকালে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ৬ সদস্যের তদন্ত কমিটি নরসিংদীর ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শনে যায়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পিজিসিবির নির্বাহী পরিচালক ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে কমিটি ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কন্ট্রোল রুম পরিদর্শন করে। দীর্ঘ তিন ঘণ্টা বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন মেশিনারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে বিকাল সাড়ে ৩টায় সেখান থেকে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের উদ্দেশে রওয়ানা দেয়। এ সময় তদন্ত কমিটির প্রধান পিজিসিবির নির্বাহী পরিচালক ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরী জানান, জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে দেশের কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাওয়ার কন্ট্রোল রুমগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। সবকটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে কী কারণে বিপর্যয় দেখা দেয়, তা জানা যাবে।
ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিদর্শনে পিজিসিবির নির্বাহী পরিচালকের সঙ্গে সংস্থার পরামর্শক শামছুর জোহা, নির্বাহী প্রকৌশলী আরেফিন সিদ্দিক, সাইদুল ইসলামসহ তদন্ত কমিটির ৬ সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এদিকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে ঘোড়াশালে ৫ নম্বর ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদন এখনো বন্ধ রয়েছে। ইউনিটটি চালু করতে কাজ চলছে বলে জানান প্রধান প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মঙ্গলবার দুপুর ২টা ৫ মিনিটে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ ট্রিপ করলে প্রথমে ঘোড়াশাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৪ ও ৫নং ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। মেরামত শেষে ৩৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৪নং ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করলেও ৫নং ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন চালু করা সম্ভব হয়নি। বন্ধ থাকা ২১০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ৫নং ইউনিটের বিভিন্ন যান্ত্রিক সমস্যা মেরামত করলেও বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তা চালু করা সম্ভব হয়নি।
এ ইউনিটটি চালু করতে আরও দুই-তিন দিন অপেক্ষা করতে হতে পারে। ইউনিটটি গরম অবস্থায় চালুর চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সম্ভব হয়নি। এখন ঠান্ডা হতে দুদিন সময় লাগবে। এরপর উৎপাদনে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
এদিকে কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, জাতীয় গ্রিডের ইস্টার্ন (পূর্ব) অঞ্চলে অনাকাঙ্ক্ষিত বিদ্যুৎ বিভ্রাটের ঘটনাটি মানবসৃষ্ট কোনো গাফিলতির কারণে হয়নি। এখন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ খুঁজে পায়নি তদন্ত কমিটি।
মঙ্গলবার দুপুর ২টা ৫ মিনিটে জাতীয় গ্রিডের ইস্টার্ন অঞ্চলে (ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ) বিদ্যুৎবিভ্রাট হয়। এ ঘটনায় ওইদিন রাতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) নির্বাহী পরিচালক (পিঅ্যান্ডডি) ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরীকে এ কমিটির প্রধান করা হয়। শিগগির মন্ত্রণালয় থেকেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হতে পারে।
তদন্ত কমিটির প্রধান আরও বলেন, ‘মূল ঘটনাটি কোথায় ঘটেছে, এটি জানার জন্য আমরা আরও কাজ করব। সাধারণত সেকেন্ডের মধ্যেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। কোনটা আগে, কোনটা পরে আবার কী কারণে এটা হলো। বিভিন্ন ডেটার তথ্য নেওয়া হয়েছে। এগুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। অধিকাংশই বিভিন্ন যান্ত্রিক ডেটা। যন্ত্রের মধ্যে সময় থাকে। কী ঘটেছিল, সেটা থাকে, বিভিন্ন গ্রাফ থাকে। এগুলো এখন এনালাইসিস করতে হবে।’ এ ঘটনায় কারও কোনো গাফিলতি দেখছেন কি না-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, হিউম্যান (মানুষের) গাফিলতি এখন পর্যন্ত আমাদের চোখে পড়েনি।’
ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরী বলেন, ‘এ ঘটনার পর মঙ্গলবার রাতেই আমরা (তদন্ত কমিটি) মিটিং করেছি। বুধবার সকাল থেকে কাজ করছি। আমরা এখন ঘোড়াশাল পাওয়ার প্ল্যান্টে আছি। আশুগঞ্জ যাব, সিরাজগঞ্জেও যাব। আমরা চেষ্টা করছি সব তথ্য সন্নিবেশিত করার পর বিশ্লেষণ করে কারণটা বের করতে। তদন্ত কমিটিতে আমরা বুয়েটের একজন প্রফেসরকেও যুক্ত করেছি। আমরা ৫ জন তদন্তে এসেছি। বুয়েটের প্রফেসরকে সকালে জানাতে পেরেছি, সেজন্য তিনি এখনো আসতে পারেননি।’
২ থেকে ৪ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ কারতে চান বলেও জানান কমিটির প্রধান। তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করব দুই-তিন বা চারদিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে। বেশি জায়গায় যেতে হলে এবং বেশি তথ্য নিলে তখন হয়তো একটু এদিক-ওদিক হতে পারে, একটু বেশি সময় লাগতে পারে। আমরা বসব। তথ্যগুলো এনালাইসিস করব। আরও যদি কোথাও যেতে হয়, আমরা যাব। যতক্ষণ না আমরা কোনো একটি উপসংহারে আসার মতো তথ্য না পাই, ততক্ষণ আমাদের কাজ করতে হবে।’
বিদ্যুৎবিভ্রাটের পর মঙ্গলবার ২টা ৩৬ মিনিটে আশুগঞ্জ-সিরাজগঞ্জ ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন চালুর মাধ্যমে ক্রমান্বয় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, ময়মনসিংহের কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করা হয়। রাত ৯টায় সিস্টেম জেনারেশন ৮ হাজার ৪৩১ মেগাওয়াটে উন্নীত করা হয় এবং সতর্কতার সঙ্গে সেটা বাড়িয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করার কাজ করা হয়। পূর্বাঞ্চলের বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো (ঘোড়াশাল, আশুগঞ্জ, মেঘনাঘাট, হরিপুর এবং সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার প্ল্যান্ট) চালু করে ধীরে ধীরে সিস্টেম স্বাভাবিক করা হয়। ঢাকায় ২ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের বিপরীতে রাত ৯টা ৪০ মিনিটে ১ হাজার ৭৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। রাতের মধ্যেই বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে জাতীয় গ্রিডের মাধ্যমেই সারা দেশে বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত আমরা যতটুকু শুনেছি, বিদ্যুৎ সরবরাহের কোনো একটি লাইন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে অন্য লাইন ওভার লোড হয়ে সেটা ট্রিপ করেছে। এ কারণে পূর্বাঞ্চলের গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বল্পতা দেখা দেয়। যার কারণে এ ঘটনা ঘটতে পারে।
২০১৪ সালের নভেম্বরে গ্রিড বিভ্রাটের কারণে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিল। গত আট বছরে ঘূর্ণিঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও গ্রিড বিপর্যয় হয়েছে।
গত ৭ সেপ্টেম্বর জাতীয় গ্রিডের একটি সঞ্চালন লাইনে বিভ্রাট দেখা দিলে রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল বিভাগসহ দেশের বিশাল এলাকা ৪০ মিনিট থেকে দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিল। এর ২৩ দিন পর মঙ্গলবার দুপুর ২টা ৫ মিনিটে পুনরায় বিভ্রাটের ঘটনা ঘটল।
ইউআর/