মাছ ধরার বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার সময় মৎস্য শ্রমিকরা একদিকে যেমন সরকারের বরাদ্দকৃত চাল সঠিক পরিমাণে পান না, তেমনই প্রদত্ত খাদ্য সহায়তা তাদের প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট না। তিন-চতুর্থাংশ অর্থাৎ ৭৫ শতাংশ মৎস্য শ্রমিক জানান, তারা বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার সময় আর্থিক সংকটে দিন পার করেছেন। এই সংকট পাথরঘাটার ৬৬ শতাংশ ও কুতুবজোমে ৮১ শতাংশ।
আর্থিক সংকট মোকাবিলায় ৫২ দশমিক ৯ শতাংশ মৎস্য শ্রমিক উচ্চ সুদে ঋণ গ্রহণ করেন এবং ৩৯ দশমিক ২ শতাংশ মৎস্য শ্রমিক বিনা সুদে ঋণ নিতে বাধ্য হন। অর্থাৎ ৯২ দশমিক ১ শতাংশ মৎস্য শ্রমিকই ঋণের মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করতে বাধ্য হন।
সমুদ্র মৎস্যজীবীদের ওপর পরিচালিত মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) ও তার সহযোগী সংগঠন বিল্স ও কোস্ট ফাউন্ডেশনের ‘মৎস্য শ্রমিকদের জেলে কার্ড প্রাপ্তি’ শীর্ষক একটি যৌথ জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এমজেএফের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শেখ গিয়াসউদ্দিন আহমেদ। স্বাগত বক্তব্য দেন প্রোগাম ডিরেক্টর বনশ্রী মিত্র নিয়োগী। মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন কক্সবাজার ফিসিং ট্রলান অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান বাহাদুর এবং জাতীয় শ্রমিক ফেডারেশনের সমাজকল্যাণ সম্পাদক এসএম জাকীর হোসেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়- আগস্ট ২০১৮ থেকে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত এই গবেষেণা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। সুইডিশ ইন্টারন্যশনাল ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন এজেন্সির (সিডা) আর্থিক সহায়তায়, ড্যানিশ ইনস্টিটিউট ফর হিউম্যান রাইটসের (ডিআইএইচআর) তত্ত্বাবধানে জরিপটি পরিচালিত হয় দুটি জেলায়।
সরকারি হিসাবে পাথরঘাটা ও মহেশখালী উপজেলায় সবচেয়ে বেশি মৎস্য শ্রমিক আছেন। জরিপটি পরিচালিত হয়- পাথরঘাটার সদর ইউনিয়ন এবং মহেশখালীর কুতুবজোম ইউনিয়নে। এখানে মৎস্য শ্রমিক আছে এমন সব পরিবারে একটি কাঠামোগত প্রশ্নমালার সাহায্যে জরিপ পরিচালনা করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়- ২০২১ সালের ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন নিষেধাজ্ঞা চলাকালে জরিপভুক্ত মৎস্য শ্রমিকদের মধ্যে শতকরা মাত্র ৪০ জন সরকারি বরাদ্দকৃত চাল পেয়েছিল। উভয় এলাকাতেই জেলে কার্ডধারী এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ শতকরা ৩২ জন মৎস্য শ্রমিক সহায়তা বঞ্চিত ছিল। অথচ ৯ শতাংশ পরিবার সরকারি সহায়তা লাভ করেছে যাদের কোনো জেলে কার্ড নেই। জরিপভুক্ত মৎস্য শ্রমিকদের মধ্যে ৪২ দশমিক ৬ শতাংশ জেলে কার্ডধারী।
২০২১ সালের ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় জরিপভুক্ত মৎস্য শ্রমিকদের মধ্যে মাত্র ৪৬ শতাংশ সরকারি বরাদ্দকৃত চাল পেয়েছিল। এ সময়ে পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নের জেলে কার্ডধারী মৎস্য শ্রমিকদের ১৯ শতাংশ কোনো চাল বরাদ্দ পায়নি। ৬৫ দিনের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় সরকারিভাবে দুই দফায় ৮৬ কেজি (প্রথম দফায় ৫৬ কেজি এবং দ্বিতীয় দফায় ৩০ কেজি) চাল খাদ্য সহায়তা হিসেবে পাওয়ার কথা।
এই দুই নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসে দেশের কিছু কিছু স্থানে জাটকা সংরক্ষণের লক্ষ্যে ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।পাথরঘাটা সদর ইউনিয়ন এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে। এই সময়ে সেখানে ৭৭ শতাংশ মৎস্য শ্রমিক সরকারি চাল সহায়তা পাওয়ার কথা জানায়। এখানেও ১৯ শতাংশ মৎস্য শ্রমিক সরকারি বরাদ্দের চাল পায়, যাদের কোনো জেলে কার্ড নেই।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়- জরিপকাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে পাথরঘাটা সদরে ৩ হাজার ১৪১ এবং কুতুবজোমে ৫ হাজার ৫০৩ পরিবরের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। পাশাপাশি বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরিপূর্ণ ধারণালাভের জন্য পাথরঘাটা উপজেলা এবং মহেশখালী উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা এবং সমাজকল্যাণ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়।
মৎস্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব গবেষণা করার মাধ্যমে ক্ষুদ্র মৎস্য শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষিত করা এবং বাংলাদেশের মৎস্য শ্রমিকদের জন্য গোষ্ঠী বীমা স্কিম প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। ক্ষুদ্র মৎস্য শ্রমিকদের অধিকারের প্রশ্নে প্রথমেই আসে তাদের জেলে কার্ডের প্রাপ্যতার বিষয়টি। জেলে কার্ড থাকলে তারা বিভিন্ন ধরনের সরকারি সাহায্য পাওয়ার জন্য যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
ইউআর/