জলাশয় ও সমতল ভূমির আগাছা কেটে পরিষ্কার করতে ব্যবহার করা হয় ‘উইড হারভেস্টর’ যন্ত্র। দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন এলাকায় এমন মেশিন ব্যবহারের ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এরপরও প্রায় ৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮টি মেশিন কিনেছে সরকার।
ইতোমধ্যে মেশিনগুলো জার্মানি থেকে দেশে পৌঁছেছে। প্রয়োজন ছাড়া মেশিন কেনার পর এবার সেগুলোর মান নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। মান যাচাই-বাছাইয়ে গঠিত কারিগরি কমিটির পরীক্ষায় মেশিনগুলো স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী সক্ষমতার প্রমাণ মেলেনি।
এজন্য ৯ সদস্যের কারিগরি কমিটি সরবরাহকৃত মেশিনগুলো না নেওয়ার সুপারিশ করেছে। তবে ক্রয়কারী সংস্থা মেশিনগুলো গ্রহণ করতে তোড়জোড় শুরু করছে।
প্রথম কারিগরি কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন না করে নতুন করে গত মাসে পৃথক ব্যক্তিদের দিয়ে কারিগরি কমিটি গঠন করেছে। নতুন কমিটির সদস্যদের চাপ প্রয়োগ বা ম্যানেজ করে নিম্নমানের যন্ত্রগুলো গ্রহণ করে নিতে পারে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, সিটি করপোরেশন এলাকায় এ ধরনের যন্ত্র ব্যবহারের সুযোগ নেই বললেই চলে।
সেক্ষেত্রে এসব যন্ত্র ক্রয়ের আগে সরকারের চিন্তা-ভাবনা করা উচিত ছিল। এক-দুটো ক্রয় করে যাচাই-বাছাই করে, ইতিবাচক ফলাফল মিললে পরে আরও কিনতে পারত।
কোনো খাতের বরাদ্দ প্রয়োজন না হলে খরচ না করে সরকারকে ফেরতে দিতে হবে। এভাবে অপ্রয়োজনীয় ও নিম্নমানের মেশিন ক্রয় করে দেশের সম্পদ অপচয় করার কোনো মানে হতে পারে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সিটি করপোরেশনের জন্য যান-যন্ত্রপাতি ক্রয় উপখাতের বরাদ্দ থেকে ৮টি উইড হারভেস্টর ক্রয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
এ ক্রয় কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে (এলজিইডি)। এ সংস্থার নগর পরিকল্পনা ও নগর অবকাঠামো উন্নয়ন শাখার তত্ত্বাবধানে এসব যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছে।
ক্রয়কারী কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন এলজিইডির ওই শাখার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোল্লা মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ।
ক্রয়ের শর্তানুযায়ী স্থানীয় সরকার বিভাগ, সিটি করপোরেশন শাখা-১ থেকে ২৮ এপ্রিল প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশনের জন্য কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়।
ওই কমিটি ৩০ মে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ইক্যুইপমেন্ট ইয়ার্ডে উইড হারভেস্টরের প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন করে। তারা দেখতে পান, ক্রয়ের দরপত্র দলিলের শর্তানুযায়ী মেশিনগুলোর প্রি-শিপমেন্ট সম্পন্ন হয়েছে।
ওই কমিটি ৩০ মে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ইক্যুইপমেন্ট ইয়ার্ডে উইড হারভেস্টরের প্রি-ডেলিভারি ইন্সপেকশন করে। তারা দেখতে পান, ক্রয়ের দরপত্র দলিলের শর্তানুযায়ী মেশিনগুলোর প্রি-শিপমেন্ট সম্পন্ন হয়েছে।
কারিগরি কমিটি পর্যবেক্ষণে দেখেছে প্রি-শিপমেন্ট ইন্সপেকশন প্রতিবেদন অনুযায়ী ৮ মেশিনই সন্তোষজনক মর্মে ক্রয়কারী সংস্থা এলজিইডি প্রত্যয়ন করেছে।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, কারিগরি কমিটি দ্বিতীয় ধাপে ৯ জুন ঢাকার বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলে সরবরাহকৃত একটি ‘উইড হারভেস্টর’ যন্ত্রের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করে।
পর্যবেক্ষণে তারা দেখতে পান, যন্ত্রটি কিছু সময় বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেলের ভাসমান কচুরিপানা অপসারণ কাজ করার পর স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী কমপ্যাকশন করতে পারেনি।
শক্ত আবর্জনা কনভেয়ার বেল্টে প্যাঁচিয়ে তা অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়। আর অল্প কচুরিপানা থাকা অবস্থায় এবং খালি অবস্থায়ও যন্ত্রটি খালের পাড়ে উঠতে ব্যর্থ হয়েছে।
এমতাবস্থায় এ যন্ত্রের কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। উইড হারভেস্টরে সংগৃহীত বর্জ্য সংগ্রহ কার্যক্রম সন্তোষজনকভাবে প্রদর্শন করতেও ব্যর্থ হয়েছে।
সরবরাহকৃত যন্ত্রটি যে জার্মানি থেকে আমদানিকৃত তার সমর্থনে কোনো সনদ কারিগরি কমিটিকে দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছে কারিগরি কমিটি।
জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) ক্রয়কারী কর্মকর্তা এবং নগর পরিকল্পনা ও নগর অবকাঠামো উন্নয়ন শাখার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোল্লা মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ বলেন, স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী ক্রয় করা হয়েছে উইড হারভেস্টর যন্ত্র।
সবকিছু যাচাই-বাছাই করে তা গ্রহণ করা হয়েছে। তবে প্রথম কারিগরি কমিটির সুপারিশ নেতিবাচক আসায় পরে আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি কাজ শুরু করেছে। তারা এসব যন্ত্রের ইতিবাচক ফলাফল দেবেন বলে আশা করছি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে গঠিত কারিগরি কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. আলী আকবর বলেন, সরবরাহকৃত ৮টি উইড হারভেস্টর যন্ত্র খুবই নিম্নমানের।
প্রথম কারিগরি পরীক্ষায় সেটা সফলভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এরপর নতুন করে আরও একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির কাজ চলছে, সেখানেও আমি আছি।
এবার চট্টগ্রামের একটি পুকুরে মেশিনটি চালানো হয়েছে। এতে সক্ষমতার প্রমাণ মিলেছে সেটা বলার কোনো সুযোগ নেই। কেননা, এটা পুকুরে চালানোর জন্য কেনা হচ্ছে না। সরবরাহকৃত যন্ত্রটি কোনোভাবে গ্রহণ করা উচিত হবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে এই প্রকৌশলী বলেন, উইড হারভেস্টর যন্ত্রগুলো জলাশয় ও সমতলের আগাছা কাটতে ব্যবহৃত হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় ওই মেশিনের কোনো প্রয়োজন নেই।
সেটি আমরা মৌখিকভাবে স্থানীয় সরকার বিভাগকে জানিয়ে দিয়েছি। অন্যান্য সিটি করপোরেশনের কি অবস্থা সেসব সিটি করপোরেশন বলতে পারবে।
অভিযোগ প্রসঙ্গে সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মো. আফতাব আহমেদ বলেন, এলজিইডি যে ধরনের স্পেসিফিকেশনের যন্ত্র আনতে বলেছে সেই মানের যন্ত্র আনা হয়েছে। এখন কারিগরি কমিটি দিয়ে এসব অকৃতকার্য করানো ঠিক হবে না।
ইউআর/