জ্বালানি তেলের পর এবার বাড়ল বাস ভাড়া। দূরপাল্লার রুটের বাস ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৮০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ২০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। যাত্রীপ্রতি এক কিলোমিটারে ভাড়া বাড়ল ৪০ পয়সা। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে চলাচলকারী বাসে ৩৫ পয়সা বাড়িয়ে ২ টাকা ১৫ পয়সা থেকে ২ টাকা ৫০ পয়সা এবং মিনিবাসে ২ টাকা ৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ৪০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। ঢাকা,গাজীপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোতে চলাচলকারী বাস ও মিনিবাস উভয়ের ভাড়া ২ টাকা ৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ৪০ পয়সা করা হয়েছে। এ হিসাবে দূরপাল্লার বাসে ২২ শতাংশ এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর বাসে ১৬.২৭ শতাংশ ভাড়া বাড়ল। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে বাসে ও মিনিবাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ ও ৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। শনিবার রাতে নতুন এই ভাড়া ঘোষণা দেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার। এই ভাড়া আজ থেকেই কার্যকর হচ্ছে।
যদিও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি হিসাবে বাস ভাড়া প্রতি কিলোমিটার সর্বোচ্চ ২৯ পয়সা বাড়তে পারে বলে শনিবার দিনে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এতে দূরপাল্লার বাসে ২৯ পয়সা এবং দুই মহানগরীর বাসে ২৮ পয়সা বাড়বে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু বিআরটিএ যথাক্রমে ৪০ ও ৩৫ পয়সা হারে ভাড়া বাড়িয়েছে। পরিবহণসংশ্লিষ্টরা জানান, বাসের ৫২ আসন ধরে এ ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। যদিও দূরপাল্লার বাসে ৪০ আসনে রূপান্তর হবে এবং এর সঙ্গে সেতু ও অন্যান্য টোল যুক্ত করে যাত্রীপ্রতি ভাড়া চূড়ান্ত করা হবে। তখন যাত্রীপ্রতি ভাড়া আরও বেড়ে যাবে। তবে সিএনজিচালিত বাসের ক্ষেত্রে এই ভাড়া প্রযোজ্য হবে না। আজ এ সংক্রান্ত ভাড়ার হার প্রকাশ করার কথা রয়েছে। এদিকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় লঞ্চ ভাড়া বাড়ানোরও প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। শিগগিরই বৈঠক করে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে এর আগে ৭ নভেম্বর বাস ভাড়া ২৭ শতাংশ বাড়িয়েছিল সরকার। ৮ মাস পর আবারও বাড়ল বাস ভাড়া। এবারও যাত্রী জিম্মি করে বাড়তি ভাড়া আদায় করে নিলেন পরিবহণ মালিক, শ্রমিক নেতারা। শুক্রবার রাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর শনিবার সকাল থেকে রাজধানীসহ সারা দেশে বাসের চরম সংকট তৈরি করা হয়। বাস না পেয়ে হাজার হাজার যাত্রী গন্তব্যে যেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। দীর্ঘ সময় পরপর বাসের দেখা মিললেও সেগুলোতে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়। এদিনই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বিআরটিএকে চিঠি দিয়ে ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব দেন।
প্রস্তাবে টায়ার, মবিল, ফিল্টারসহ ছয় ধরনের যন্ত্রাংশের দাম বৃদ্ধির হার উল্লেখ করে বলা হয়, এসব যন্ত্রাংশের জন্য ২৭ দশমিক ৫৫ শতাংশ ও ডিজেলের দাম বাড়ায় ৪২ দশমিক ৫০ শতাংশ, সবমিলিয়ে বাস পরিচালনায় ৭০ শতাংশ খরচ বেড়েছে। ওই বৃদ্ধির হারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে ভাড়া বাড়ানোর প্রস্তাব করেন তিনি। বিকালেই পরিবহণ নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করা হলো। এ সময় সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী, খন্দকার এনায়েত উল্যাহসহ পরিবহণ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
সাপ্তাহিক বন্ধের মধ্যে শুক্রবার রাতে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয় সরকার। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ৮০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১১৪ টাকা করা হয়। পেট্রোলের দাম ৮৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৮৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ নতুন ঘোষণা অনুযায়ী, ডিজেল ও কেরোসিনের দাম প্রতি লিটারে বেড়েছে এক লাফে ৩৪ টাকা, অকটেনের দাম ৪৪ টাকা ও পেট্রোলের দাম ৪৬ টাকা।
বাস ভাড়া বাড়ানোর বৈঠকের পর সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, শুক্রবার রাত ১২টা থেকে জ্বালানি তেলের দাম কার্যকর করেছে সরকার। বৈশ্বিক কারণে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। পৃথিবীর যে কোনো দেশের চেয়ে আমাদের দেশে জ্বালানি তেলের দাম কম। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে পরিবহণ মালিক সমিতিসহ স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে বৈঠক করে থাকি। শুক্রবার ভাড়া বাড়ানোর পর আজ (শনিবার) বৈঠক করে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। সচিব দাবি করেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পরও সারা দেশে পরিবহণ ব্যবস্থা সচল ছিল। ধর্মঘটে না যাওয়ার জন্য তিনি পরিবহণ মালিকদের ধন্যবাদ জানান।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান নতুন ভাড়া ঘোষণা করে বলেন, আমরা কয়েক ঘণ্টা ভাড়া পুনর্নির্ধারণ কমিটির সদস্যদের নিয়ে আলোচনা করে তেলের দাম ও যাবতীয় খরচ সমন্বয় করে ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করেছি। মন্ত্রীর অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গতবার ভাড়া নির্ধারণের পর মালিক, শ্রমিক ফেডারেশন, পুলিশ ও বিআরটিএ বাড়তি ভাড়া নেওয়ার বিরুদ্ধে কয়েক মাস অভিযান পরিচালনা করে। এবারও বাড়তি ভাড়ার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।
দিনভর বাড়তি ভাড়া আদায় প্রসঙ্গে বিআরটিএর চেয়ারম্যান বলেন, যে কোনোভাবে অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেব। আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবেন। জেলা প্রশাসকদের ম্যাজিস্ট্রেটরাও বিষয়টি মনিটরিং করবেন।
ভাড়া বৃদ্ধির পর খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, দেশে প্রায় এক লাখ বাস চলে। ঢাকা মহানগরীতে সর্বোচ্চ ছয় হাজার বাস চলে। এক্ষেত্রে অনেক সময় কিছু অনিয়ম হয়। অনিয়ম বন্ধে আমরা মাঠে ছিলাম। সব অনিয়ম বন্ধ করতে পেরেছি তা নয়। তিনি বলেন, এবার শুধু তেলের দামের প্রেক্ষিতে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা তা মেনে নিয়েছি।
এর আগে বাস মালিক ও শ্রমিকদের দাবির মুখে ৭ নভেম্বর দূরপাল্লার বাস ভাড়া ২৭ শতাংশ এবং ঢাকায় ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়েছিল সরকার। তখন দূরপাল্লার বাস ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়। অর্থাৎ কিলোমিটারপ্রতি ৩৮ পয়সা ভাড়া বাড়ে। এছাড়া বড় বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা ও মিনিবাসে ৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগর এলাকায় চলাচলরত বাসের ভাড়া কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়। প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বাড়ানো হয় ৪৫ পয়সা। আর মিনিবাসের ভাড়া ১ টাকা ৬০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ৫ পয়সা করা হয়। সেখানেও কিলোমিটারপ্রতি ৪৫ পয়সা হারে বাড়ানো হয়।
১১ বছরে বাসের ভাড়া দ্বিগুণের বেশি বাড়ল : জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে গত ১১ বছরে বাসের ভাড়া দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। ২০১১ সালে দূরপাল্লার বাস ভাড়া ছিল প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ১৫ পয়সা। ওই বছরই দুবার ভাড়া বাড়িয়ে ১ টাকা ৩৫ পয়সা করা হয়। ২০১৩ সালে ডিজেলের দাম লিটারে ৭ টাকা বাড়লে বাস ভাড়া বাড়িয়ে ১ টাকা ৪৫ পয়সা করা হয়। পরে জ্বালানি তেলের দাম কমলে দূরপাল্লার বাস ভাড়া ৩ পয়সা কমিয়ে ১ টাকা ৪২ পয়সা করা হয় ২০১৬ সালে। ২০২১ সালে সরকার ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করলে দূরপাল্লার বাস ভাড়া ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বেড়ে ১ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়। শনিবার আবার তা বাড়িয়ে ২টাকা ২০ পয়সা করা হলো।
একইভাবে ২০১১ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর বাসে ১ টাকা ৪৫ পয়সা ও মিনিবাসে ১ টাকা ৪৫ পয়সা ভাড়া ছিল। ২০১১ সালে দুবার, ২০১৫ সালে একবার ও ২০২১ সালে আরেকবার বাড়িয়ে বাস ভাড়া ২ টাকা ১৫ পয়সা ও মিনিবাসে ২ টাকা ৫ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। শনিবার আবারও বাড়িয়ে বাসে ২ টাকা ৫০ পয়সা ও মিনিবাসে ২ টাকা ৪০ পয়সা করা হয়েছে।
ইউআর/