রাজধানীর নিউমার্কেটে সংঘর্ষের সময় কুরিয়ার সার্ভিস কর্মী নাহিদ হত্যায় ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের ছয়টি গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। তবে কলেজে কমিটি না থাকায় এসব গ্রুপের সদস্যদের কোনো সাংগঠনিক পদ নেই।
যারা হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে তারা আগের কমিটির নেতাদের সঙ্গে কয়েকটি গ্রুপে কার্যক্রম চালাত। তারা সাবেক সভাপতি, সাবেক সাধারণ সম্পাদক অথবা সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদকের অনুসারী। আবার কেউ সাবেক আহ্বায়ক কমিটির গুরুত্বপূর্ণ ছাত্রলীগ নেতার অনুসারী।
সামনের কমিটিতে তাদের প্রায় সবাই উচ্চ পদপ্রত্যাশী ছিল। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এবং এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) উচ্চপর্যায়ে সূত্র মঙ্গলবার যুগান্তরকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত দুজনের মধ্যে কুরিয়ার সার্ভিস কর্মী নাহিদ হত্যায় ছয়জন শনাক্ত হলেও দোকানকর্মী মুরসালিন হত্যায় এখনো কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো ইউনিট।
তবে গত কয়েক দিনে র্যাব এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দফায় দফায় আটক করছে। আটককৃতদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত তথ্য না পাওয়ায় তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন র্যাবের লিগ্যাল আন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
অন্যদিকে যাদের শনাক্ত করা হয়েছে তাদের কয়েকজকে দু-এক দিনের মধ্যে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে বলে আশা প্রকাশ করেন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। তিনি আরও জানান, নাহিদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের ছয়টি গ্রুপের সংশ্লিষ্টতার তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, ঘটনার সূত্রপাত নিউমার্কেটের একটি ফাস্টফুডের দোকানে। ১৮ এপ্রিল রাতে নিউমার্কেটের ৪ নম্বর গেটে কাউছারের ফাস্টফুডের দোকানের সামনে ইফতারসামগ্রী বিক্রির জন্য দোকান বসাতে চায় বাপ্পী।
তখন কাউছার বাধা দেয়। পরে বাপ্পী ঢাকা কলেজে গিয়ে তিন ছাত্রলীগ নেতা নাসিম, লিটন ও আব্দুল্লাহ আল মাসউদকে ডেকে আনে। ছাত্রলীগ নেতারা এসে কাউছার ও তার লোকদের ওপর চড়াও হন। এ সময় কাউছারের লোকজন ছাত্রলীগ নেতা নাসিম ও লিটনকে বেধড়ক পেটায়।
ঘটনাস্থল থেকে ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসউদ ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে ফিরে গিয়ে গুজব ছড়ান, খাবারের বিল পরিশোধ করা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের একপর্যায়ে দোকানকর্মীরা তাদের ওপর হামলা করছেন।
পরে ছাত্রলীগ নেতাদের নেতৃত্বে কলেজ ছাত্ররা ওই ফাস্টফুডের দোকানে এসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তখন ব্যবসায়ীরা প্রতিবাদ করেন। তখন পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরদিন সকাল থেকে দুপক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে যায়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, যখন দুপক্ষ দুদিকে অবস্থান নেয়, তখন থেকেই আমরা চেষ্টা করি তারা যেন কোনো সংঘাতে না জড়ায়।
এজন্য আমরা কলেজের ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালসহ শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলি। ব্যবসায়ী এবং হকার নেতাদের সঙ্গে কথা বলি। শিক্ষকদের বলি, ছাত্রদের সরিয়ে নিতে। অপরদিকে হকার-ব্যবসায়ী নেতাদের বলি দোকানিরা যেন মার্কেটের ভেতর চলে যান।
কিন্তু ব্যবসায়ী নেতা এবং শিক্ষকদের কেউই হকার-ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলি। তাদের ঘটনাস্থলে পাঠাই। বলি, ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি নেই।
সেখানে বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপ আছে। আপনারা গিয়ে দেখেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিনা। ছাত্রলীগ নেতারাও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি। উলটো পরিস্থিতি খারাপ হয়।
এক প্রশ্নের উত্তরে ডিএমপি কমিশনার জানান, আহত দোকান কর্মচারী মুরসালিন মারা গেছেন ইট-পাটকেলের আঘাতে। ছাত্রদের ইট-পাটকেলে নাকি, হকারদের ইট-পাটকেলে সে মারা গেছে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ছবি এবং ভিডিও দেখে এ পর্যন্ত রামদাওয়ালা ছয়জনকে আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি। রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় নাহিদকে যে কুপিয়েছে তাকেও আমরা শনাক্ত করেছি।
সংঘর্ষে জড়িত সবাইকে ধরতে আমাদের একাধিক টিম মাঠে আছে। দু-এক দিনের মধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে পারব বলে আশা করছি।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নাহিদ হত্যার ঘটনায় ছাত্রলীগের যে ছয়জনকে শনাক্ত করা হয়েছে তারা হলো-বাশার ইমন, শাহাদাৎ হোসেন, কাইয়ুম, সুজন সরকার, শাহীন সাদেক মীর্জা ও কাউসার হামিদ ওরফে সাদা কাউসার।
এদের মধ্যে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুরিয়ার সার্ভিস কর্মী নাহিদ হোসেনকে কুপিয়েছে ইমন। সে ঢাকা কলেজের স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্র। সে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সামাদ আজাদ ওরফে জুলফিকারের অনুসারী।
শাহাদাৎ স্টিলের পাইপ হাতে হামলা ও সংঘর্ষে অংশ নিয়েছিল। সে ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের বিলুপ্ত আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জসীম উদ্দিনের অনুসারী হিসাবে ক্যাম্পাসে পরিচিত।
র্যাব লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, নিউমার্কেটে সংঘর্ষের ঘটনায় আমরা বেশ কয়েকজনকে শনাক্ত করেছি। এদের মধ্য ইমন এবং কাইয়ুম রয়েছে। আমরা যাদের শনাক্ত করেছি, তাদের সবাইকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
এখনো কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। তবে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছিল। তাদের ২-৩ ঘণ্টা করে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কারও বিরুদ্ধে ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না।
বিএনপির ১৪ নেতাকর্মীর হাইকোর্টে জামিন : রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের দুই মামলায় নিউমার্কেট থানা যুবদলের সভাপতি আমির হোসেনসহ বিএনপির ১৪ নেতাকর্মীকে আগাম জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট।
মঙ্গলবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালতে জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার কায়সার কামাল।
এর আগে ২১ এপ্রিল রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের করা দুই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ৭ জুন দিন ধার্য করেন আদালত। ঢাকার মেট্রোপলিট ম্যাজিস্ট্রেট শুভ্রা চক্রবর্তী মামলার এজাহার গ্রহণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিনটি ধার্য করেন।
ঢাকা কলেজের তদন্ত কমিটি : ঢাবি প্রতিনিধি জানান, রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের ঘটনায় ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সম্পৃক্ততা ছিল কি-না, তা খুঁজতে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ সোমবার তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে। কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। গণিত বিভাগের অধ্যাপক অখিল চন্দ্র বিশ্বাসকে প্রধান করে এই কমিটি করা হয়।
১৮ এপ্রিল রাতে রাজধানীর নিউমার্কেটের ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হয়, আহত হন দুপক্ষের লোকজন, সাংবাদিকসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৪টি মামলা করা হয়েছে। মামলাগুলো তদন্তাধীন রয়েছে।
ঢাকা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এটিএম মইনুল হোসেন মঙ্গলবার সন্ধ্যায় যুগান্তরকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, সংঘর্ষের ঘটনায় আমাদের ছাত্রদের সম্পৃক্ততা ছিল কি-না, তা খুঁজে দেখার জন্য কলেজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।
ইউআর/