গতি নেই ‘ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) উইথ ডাবল পাইপলাইন’ প্রকল্পে। ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও জুন পর্যন্ত বাস্তব অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৬৬ দশমিক ১০ শতাংশ।
এছাড়া আর্থিক অগ্রগতি আরও কম অর্থাৎ ৫৭ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এ সময়ে ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ৮০৮ কোটি ৯৫ লাখ টাকা।
এ অবস্থায় তৃতীয় সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। ফলে ৩ বছরের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সময় যাচ্ছে সাড়ে ৭ বছর। এতে মূল ব্যয়ের তুলনায় অতিরিক্ত খরচ হবে প্রায় ২ হাজার ১৮৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির কারণে বাধাগ্রস্ত হয়েছে ক্রয় কার্যক্রম। ফলে সেই জের ধরেই সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের একাধিক কর্মকর্তা জানান-বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর গত বছরের ৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। ওই সভার সুপারিগুলো প্রতিপালন করায় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) আগামী বৈঠকে উপস্থাপনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে প্রকল্প বাস্তবায়কারী সংস্থা ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান রোববার যুগান্তরকে বলেন, এটি অত্যন্ত উচ্চ প্রযুক্তির একটি প্রকল্প। বাংলাদেশে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা এটিই প্রথম। ফলে নানা কারণে দেরি হয়েছে। তবে আগস্টের মধ্যে এর মেকানিক্যাল কার্যক্রম শেষ হবে। এরপর টেস্টিং ও কমিশনিংয়ের কাজ করা হবে। ইতোমধ্যেই বয়া (যেখানে জাহাজ ভিড়বে) তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। আশা করছি বর্ধিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যাবে।
প্রকল্পটির সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে বৈদেশিক যাতায়াতের নিষেধাজ্ঞার কারণে ঠিকাদাররা যথাসময়ে কাজ করতে পারেননি। এছাড়া প্রকল্পের মালামাল সরবরাহে দেরি হওয়া এবং অফিস ফ্যাক্টরিগুলো বন্ধ থাকায় প্রকল্পের প্রকিউরমেন্ট (কেনাকাটা) সংক্রান্ত কাজ আগে সম্পন্ন করা যায়নি। আরও বলা হয়, প্রকল্পের মূল ব্যয় ছিল ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। প্রথম সংশোধীর মাধ্যমে ৪৯০ কোটি ২৯ লাখ টাকা বাড়িয়ে করা হয় ৫ হাজার ৪২৬ কোটি টাকা। এতেও কাজ শেষ হয়নি। ফলে দ্বিতীয় সংশোধনের মাধ্যমে আরও বাড়ানো হয় ১ হাজার ১৪২ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ফলে এ পর্যায় মোট ব্যয় দাঁড়ায় ৬ হাজার ৫৬৮ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এখন তৃতীয় সংশোধনের মাধ্যমে ব্যয় আর ৫৫৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকা বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। ফলে মোট ব্যয় দাঁড়াবে ৭ হাজার ১২৪ কোটি ৬২ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। পর্যালোচনা করে দেখা যায় প্রকল্পটির মূল ব্যয়ের তুলনায় বাড়তি খরচ যাচ্ছে প্রায় ২ হাজার ১৮৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।
এদিকে ২০১৫ সালের নভেম্বর হতে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের লক্ষ্য ছিল। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এর মধ্যেও শেষ হয়নি কাজ। ফলে দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ করা হয়। এতেও শেষ না হওয়ায় এখন তৃতীয় সংশোধনীতে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলে এটি বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) আওতাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল)।
প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ইআরএল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। যেটি পেট্রোলিয়ামজাত পণ্যসামগ্রী উৎপাদনে নিয়োজিত দেশের একমাত্র সরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠান। বর্তমানে দেশের জ্বালানি তেলের চাহিদার ২০ শতাংশ ইআরএল পূরণ করে এবং বাকি ৮০ শতাংশ জ্বালানি তেল আমদানি করার প্রয়োজন হয়। দেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি তেলের চাহিদা পূরণের জন্য আমদানি করা ক্রুড অয়েল এবং ফিনিশড প্রডাক্ট সহজে নিরাপদে স্বল্প খরচে ও স্বল্প সময়ে খালাস করার জন্য প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। এটির কাজ শেষ হলে লাইটারেজ অপারেশনের প্রয়োজন হবে না। তাই এ খাতে পরিবহণ ব্যয় ও অপচয় কমবে। ইআরএলের বাৎসরিক অপরিশোধিত তেল প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষমতা ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন টনে উন্নীত হবে এবং বছরে সরকারের প্রায় ৮০০ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির কারণ হিসাবে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ বলেছে, প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শেষে টেকিং ওভার সার্টিফিকেট ইস্যু, ঠিকাদারের বিল প্রদান, আয়কর-ভ্যাট ইত্যাদি পরিশোধসহ অন্যান্য কাজ করার জন্য প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদকাল এক বছর বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৫ সালে এসপিএম প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্দান্ত নেওয়ার পরবর্তী সময়ে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় সরকার আরও কিছু জাতীয় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেয়। এরমধ্যে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প। সাবমেরিন চলাচলের জন্য বাংলাদেশ নৌ বাহিনী কুতুবদিয়া (নেভি) চ্যানেলে কার্যক্রম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। স্টেকহোল্ডারদের (সুবিধাভোগী) প্রয়োজন অনুসারে এ প্রকল্পের পাইপলাইন স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী কুতুবদিয়া (নেভি) চ্যানেল চার্ট ডেটাম লেভেল (সিডিএল) থেকে ১৯ মিটার গভীরে এবং মাতারবাড়ি অ্যাপ্রোচ চ্যানেলে সিডিএল হতে ২২ দশমিক ৫ মিটার নিচে স্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয়। যে কারণে প্রকল্পের পাইপলাইন সাগরের তলদেশ থেকে কুতুবদিয়া (নেভি) চ্যানেলে ৬ থেকে ৭ মিটার গভীরে এবং মাতারবাড়ী চ্যানেলে ৮ থেকে ৯ মিটার গভীরে স্থাপন করা হয়েছে। ফলে মূল ডিজাইনে ছিল ১ দশমিক ৫ মিটার। এসব কার্যক্রমের সঙ্গে সমন্বয় করে এই প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে ঠিকাদারকে দিয়ে মূল চুক্তির কর্মপরিধিবহির্ভূত কাজ করা হয়েছে। এটি ব্যয় বৃদ্ধির অন্যতম একটি কারণ। পাশাপাশি প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আইএলএফ কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ার্স, জার্মানির সঙ্গে সম্পাদিত মূল চুক্তির কর্মপরিধির বাইরে অতিরিক্ত কাজ করা হয়েছে। এছাড়া আইটি, ভ্যাট, ব্যাংক চার্জ, বিভিন্ন ফি এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ইউআর/