ভারতকে ট্রান্সমিশন সুবিধার বিনিময়ে জলবিদ্যুৎ চায় বাংলাদেশ

বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় অরুণাচল থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপন করতে দেওয়ার বিনিময়ে সে দেশের কাছ থেকে জলবিদ্যুৎ পেতে চায় বাংলাদেশ। এ কথা জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজ রোববার বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সঙ্গে আলাপকালে আরও বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি পারস্পরিক সুবিধার জন্য এ প্রস্তাব করেন। কারণ, অরুণাচল প্রদেশ এবং তৎসংলগ্ন উত্তর-পূর্ব ভারতীয় অঞ্চলগুলো বিপুল পরিমাণ নবায়নযোগ্য জ্বালানি শক্তির উৎস।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা আমাদের আগ্রহ প্রকাশ করেছি এবং আমি তাঁকে (ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী) বলেছি যে, আপনাকে এখন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে জলবিদুৎ প্রেরণ করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হবে। সে ক্ষেত্রে আপনি আমাদের সমতল ভূমি ব্যবহার করে ব্যয় হ্রাস করতে পারেন। ওইসময় জবাবে মোদি জানান, ভারত অরুণাচল প্রদেশ এবং অন্যান্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের জলবিদ্যুতের যাবতীয় সম্ভাবনা অনুসন্ধান করার পরিকল্পনা করছে। ভারত এরই মধ্যে জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পরামর্শ করেছে।

ড. এ কে আবদুল মোমেন আরও বলেন, আমাদের দেশের ভেতর দিয়ে উচ্চ ভোল্টেজের গ্রিডলাইনের মাধ্যমে সঞ্চালন হতে যাওয়া জলবিদ্যুতের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পাওয়ার প্রত্যাশা করছি আমরা।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী দিয়ে তার নৌপথের ব্যবহার বাড়ানোর পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ সঞ্চালন করিডোর স্থাপন করে সংযোগের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় অগ্রণী ভূমিকা নিতে চায়।

বাসস জানায়, বাংলাদেশ বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর থেকে ভেড়ামারা হয়ে প্রায় ১১০০ মেগাওয়াট এবং উত্তর-পূর্ব ত্রিপুরা রাজ্য থেকে আখাউড়া হয়ে ১৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছে।

জ্বালানি খাতে ২০১৪ সালে ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা বিষয়ক যৌথ পরিচালনা কমিটির সপ্তম বৈঠকে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া বা জামালপুরসহ তিনটি রুট ব্যবহার করে ভারত আসাম থেকে তার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলগুলোতে বিদ্যুৎ প্রেরণ করতে পারে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ৬ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ট্রান্সমিশন লাইন বাংলাদেশের বড়পুকুরিয়ার ভেতর দিয়ে নির্মাণ করা হলে দৈর্ঘ্যে ১০০ কিলোমিটার এবং জামালপুরের মধ্য দিয়ে নির্মিত হলে ২০০ কিলোমিটার হতে পারে এবং প্রতিটি রুটে একটি সাবস্টেশন নির্মাণ করতে হবে।

ট্রান্সমিশন লাইনের দুটি সম্ভাব্য রুট হলো- আসামের বনগাঁ থেকে বড়পুকুরিয়া (দিনাজপুর) বা জামালপুর থেকে বিহারের পুনিয়া এবং আসামের শিলচর থেকে মেঘনা ঘাট-ভেড়ামারা হয়ে পশ্চিমবঙ্গ।

তবে প্রতিবেদনে তৃতীয় সঞ্চালন করিডোর সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়নি।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, বাংলাদেশ তার ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে ভারতীয় ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপনের অনুমতি দেওয়ার মাধ্যমে সঞ্চালিত মোট বিদ্যুতের ২০-২৫ শতাংশ কেনার পাশাপাশি হুইলিং চার্জ থেকে লাভবান হতে পারে।

এ বিষয়ে ড. মোমেন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে প্রতিশ্রুতির আলোকে বাংলাদেশ ধাপে ধাপে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে চায়। এ লক্ষ্যে জ্বালানি সূত্রগুলো নবায়নযোগ্য উৎস অন্বেষণ করছে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের কাছে নবায়নযোগ্য শক্তির অনেক উৎস নেই। কারণ, এখানে বায়ুশক্তি ব্যবহার সম্ভব হয় না এবং সৌর প্যানেলও খুব ব্যয়বহুল। তাই, জলবিদ্যুৎই নবায়নযোগ্য জ্বালানির একমাত্র ভরসা।’

মোমেন উল্লেখ করেন, বাইডেন প্রশাসন পুনরায় প্যারিস চুক্তিতে ফিরে এসেছে এবং বিদ্যুৎ খাতকে সবুজ জ্বালানিতে রূপান্তর এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরে বিপুল বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে।

ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, এই মাসের শুরুতে জলবায়ু সম্পর্কিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত জন কেরি ঢাকা সফরের সময় আমরা এখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে মার্কিন বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি চেয়েছি।

এ ছাড়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরামর্শ দেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন ব্যবস্থার অধীনে দক্ষিণ এশিয়ার জলবিদ্যুৎ খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করতে পারে।

ভারতের নর্থ-ইস্টার্ন ইলেক্ট্রিক কো-অপারেশনের মতে, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রায় ৫৮ হাজার ৯৭১ মেগাওয়াট বিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে,যা ভারতের মোট জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনার প্রায় ৪০ শতাংশ।

বর্তমানে ভারতের মোট ১ লাখ ৪৫ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বর্তমানে মোট পরিমাণের মাত্র ৪৫ হাজার ৩৯৯.২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে।

ভারতের থিঙ্ক ট্যাংক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ওআরএফ) গত বছর এক সমীক্ষা রিপোর্টে বলেছে, ২০১৯ সালে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ২৫ মেগাওয়াটের বেশি ক্ষমতার মাত্র ১৮টি প্রকল্প নির্মাণাধীন রয়েছে।

বিষয়টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এটি ঢাকাকে একটি বিস্তৃত ট্রান্সমিশন লাইন স্থাপনের পরিকল্পনা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে, যা প্রায় ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সঞ্চালনে সক্ষম হবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা বিশ্বাস করে যে, ত্রিপুরা-কুমিল্লা, বঙাইগাঁও (আসাম)-জামালপুর, দিনাজপুর-পূর্ণিয়া (বিহার), শিলচর (আসাম) এবং ফেঞ্চুগঞ্জে এ জাতীয় উচ্চ-ক্ষমতা সম্পন্ন আন্তঃসংযোজক হতে পারে।

বাংলাদেশ গত এক দশক থেকে ভারত, ভুটান, নেপাল ও মিয়ানমারকে নিয়ে এ অঞ্চলে বিশাল বিদ্যুৎ বিনিময় নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার প্রত্যাশায় রয়েছে।

কর্মকর্তারা বলেন, নেপাল ও ভুটানের ৩০ হাজার মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে এবং সে কারণে, বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল এবং বাংলাদেশ-ভারত-ভুটানের মধ্যে যৌথ বিনিয়োগ প্রকল্পের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ।

- Advertisement -spot_img
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ

- Advertisement -spot_img

এই বিভাগের আরও

- Advertisement -spot_img