টানা দ্বিতীয় কোপা আমেরিকা শিরোপা জয়ের লক্ষ্য নিয়েই আজ কলম্বিয়ার বিপক্ষে মাঠে নেমেছিল আর্জেন্টিনা। দুই দলের ফাইনাল ম্যাচের শুরু থেকেই আজ ছিল চরম নাটকীয়তা। দর্শকদের চরম বিশৃঙ্খলার কারণে খেলা শুরু হয় ১ ঘন্টা ১০ মিনিট পর। এরপর খেলা শুরু হলেও প্রথমার্ধে লিওনেল স্কালোনির শিষ্যদের উপর। ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে চোট নিয়ে মাঠ ছাড়েন লিওনেল মেসি। মেসির বদলি হিসেবে নামা নিকো গঞ্জালেস এরপর গোলের দেখা পেলেও অফসিয়াডের কারণে তা বাতিল হয়। তবুও মনোবল হারাল না আর্জেন্টিনা। দেশের হয়ে বিদায়ী ম্যাচে নিজেকে উজাড় করে দিলেন আনহেল দি মারিয়া। তবুও তাদের সঙ্গে সমান তালেই লড়াই করছিল কলম্বিয়া।
অসীম চাপ নিয়ে আর্জেন্টিনা খেলে গেল কোপা আমেরিকার শেষের এক ঘণ্টা। তবে আর্জেন্টিনা খেলেছে নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে। কোপা আমেরিকার ফাইনালে লাউতারো মার্টিনেজের ১১২ মিনিটের গোলে ১-০ গোলের জয়ে কলম্বিয়ার অজেয় যাত্রা থামিয়ে নিজেদের ইতিহাসের ১৫তম কোপা আমেরিকার শিরোপা নিশ্চিত করল আর্জেন্টিনা।
উরুগুয়ের সঙ্গে সমান ১৫ শিরোপা নিয়ে সর্বোচ্চ কোপা জয়ী তালিকায় যৌথভাবে ছিল আর্জেন্টিনা। তবে টুর্নামেন্টটির ৪৮তম আসরের ফাইনালে কলম্বিয়াকে হারিয়া টানা দ্বিতীয় শিরোপা ঘরের তোলার পাশাপাশি টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ ১৬ শিরোপার মালিক এখন আর্জেন্টিনা।
এর আগে ২০২১ সালের কোপার ফাইনালে ব্রাজিলকে ১ গোলে হারিয়ে ১৫তম কোপা আমেরিকা শিরোপা জিতেছিল আর্জেন্টিনা। সেবার একমাত্র গোলটি করেন ডি মারিয়া। এবার কলম্বিয়াকেও ম্যাচের একমাত্র গোলে হারিয়ে শিরোপা ধরে রাখলো আর্জেন্টিনা।
এই ম্যাচ দিয়েই নিজের বর্ণিল ক্যারিয়ার শেষ করেছেন আনহেল ডি মারিয়া। শেষটা তার জন্য হলো ছবির মতোই সুন্দর। ২০২১ সালে মারাকানায় তার গোল দিয়েই আর্জেন্টিনা শুরু করেছিল শিরোপা জয়ের এক যাত্রা। এরপর থেকে আরও দুই শিরোপা জয়ের সাক্ষী হয়েছেন। ২০২২ সালের ফিনালিসসিমা আর বিশ্বকাপের ফাইনালে গোল করেছিলেন। আজ গোল না পেলেও লিওনেল মেসির অনুপস্থিতিতে দলের পাপেট মাস্টার হয়ে ছিলেন ডি মারিয়া।
ম্যাচের ৬৩ মিনিটে অ্যাঙ্কেল ইনজুরির কারণে উঠে যেতে হয়েছিল লিওনেল মেসিকে। নামলেন নিকো গঞ্জালেস। ডি মারিয়া আর্মব্যান্ড বাঁধলেন শক্ত করে। যেন দায়িত্বটা বুঝে নিলেন। এরপর ডানপ্রান্ত থেকে একের পর এক বিপজ্জনক ক্রস করে গিয়েছেন ডি মারিয়া। ৩৬ বছর বয়সে এসেও খেললেন ২৬ বছরের টগবগে এক তরুণের মতো করে।
প্রথম ৪৫ মিনিটে স্পষ্ট আধিপত্য ছিল কলম্বিয়ার। বল দখলের লড়াইয়ে কিছুটা এগিয়ে থাকা নেস্তর লরেন্সোর দল প্রথমার্ধে গোলের জন্য নেয় আটটি শট, এর চারটি ছিল লক্ষ্যে। আর আর্জেন্টিনার তিনটি শটের কেবল একটি ছিল লক্ষ্যে।
দ্বিতীয়ার্ধে বাড়ে আর্জেন্টিনার আক্রমণের ধার। বল দখলের লড়াইয়ে আধিপত্য ধরে রাখে কলম্বিয়াই। তবে পরের ৪৫ মিনিটে তাদের ছয় শটের একটিও লক্ষ্যে থাকেনি। বিপরীতে আরও চারটি শট করে দুটি লক্ষ্যে রাখে আর্জেন্টিনা।
শুরুটা অবশ্য ভালো করেছিল আর্জেন্টিনাই। প্রথম মিনিটে গনসালো মন্টিয়েলের ক্রসে ডি-বক্সের মাঝে বল পেয়ে যান হুলিয়ান আলভারেস। কিন্তু তার ডান পায়ের শট বাম পাশ দিয়ে চলে যায় বাইরে।
এরপর প্রায় ১৫ মিনিট ধরে চলে কলম্বিয়ার দাপট। পঞ্চম মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে বাম পায়ের শট নেন লুইস দিয়াস। তেমন গতি না থাকায় ঠেকাতে সমস্যা হয়নি এমিলিয়ানো মার্তিনেসের।
এক মিনিট পর ডি-বক্সের ভেতর থেকে হন কর্দোবার শট দূরের পোস্টে লেগে বাইরে চলে যায়। এরপর আরও দুই দফা আর্জেন্টিনার রক্ষণে হানা দেয় কলম্বিয়া। তবে লিসান্দ্রো মার্তিনেস, নিকোলাস তাগলিয়াফিকোদের রক্ষণ ভাঙতে পারেনি তারা।
পঞ্চদশ মিনিটে ফ্রি-কিক পেয়ে গোলরক্ষক বরাবর মারেন রদ্রিগেস।
২০তম মিনিটে বড় সুযোগ পায় আর্জেন্টিনা। জায়গা বদলে বাম পাশে চলে আসেন আনহেল দি মারিয়া। তার ঠাণ্ডা মাথার ক্রস ডি-বক্সে পেয়ে বাম পায়ের শট করেন লিওনেল মেসি। কিন্তু আলভারেসের পায়ে লেগে গতি হারায় বল। ফলে সহজেই ঠেকিয়ে দেন কলম্বিয়া গোলরক্ষক কামিলো ভার্গাস।
৩৩তম মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে আচমকা দূরপাল্লার শট নেন লের্মা। ডান দিকে ঝাঁপ দেওয়া এমিলিয়ানোর আঙুল ছুঁয়ে পোস্টে লেগে বল চলে যায় বাইরে।
দুই মিনিট পর ডি-বক্সের মুখে বল পেয়ে কলম্বিয়ার একজনের চ্যালেঞ্জের মুখে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাইলাইনের কাছে পড়ে যান মেসি। চোট পান ডান পায়ে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে মাঠেই শুশ্রূষা নিয়ে নিজ পায়ে দাঁড়ান আর্জেন্টিনা অধিনায়ক। বিরতির আগের বাকি সময়টায় তাকে খুড়াতে দেখা যায়।
৪০তম মিনিটে রিচার্ড রিয়োসের ক্রসে হন আরিয়াসের দুর্বল হেড ঠেকান এমিলিয়ানো। পরের মিনিটে ডি-বক্সের বাইরে থেকে জোরাল শট নেন রিয়োস। বাম দিকে ঝাঁপিয়ে থামান আর্জেন্টিনা গোলরক্ষক।
৪৩তম মেসির ফ্রি কিকে তাগলিফিয়াকোর হেড চলে যায় বারের ওপর দিয়ে। গোল ছাড়াই বিরতিতে যায় দুই দল।
বিরতির পর একই গতিতে চলতে থাকে খেলা। ৪৭তম মিনিটে কর্দোবার ফ্লিকে বল পেয়ে ডি-বক্সের ডান পাশ থেকে সান্তিয়াগো আরিয়াসের ডান পায়ের শট অল্পের জন্য দূরের পোস্ট দিয়ে বাইরে চলে যায়।
পরের মিনিটে ডি-বক্সের মধ্যে দারুণ জায়গায় পান আলেক্সিস মাক আলিস্তের। কিন্তু শট করতে পারেননি তিনি। তার আলতো টোকায় বল পেয়ে জোরাল শট করেন দি মারিয়া। খুব কাছ থেকে রুখে দেন কলম্বিয়া গোলরক্ষক।
৫৪তম মিনিটে রদ্রিগেসের কর্নার কিক থেকে হেডে দাভিনসন সানচেসের দিকে দেন কর্দোবা। ফাঁকায় পেয়েও পরের হেড লক্ষ্যে রাখতে পারেননি সানচেস। বল চলে যায় বারের ওপর দিয়ে। তিন মিনিট পর দি মারিয়ার ক্রসে ডি-বক্সের মাঝ থেকে হেড করেন মাক আলিস্তের। কলম্বিয়ার এক ডিফেন্ডারের হাতে লেগে ফিরে আসে বল। তবে হাত সহজাত অবস্থানে থাকায় পেনাল্টি পায়নি আর্জেন্টিনা।
পরের মিনিটে বাম পাশ থেকে দি মারিয়ার বাম পায়ের প্লেসিং শট বাম দিকে ঝাঁপিয়ে দারুণ ক্ষিপ্রতায় ঠেকান ভারগাস। ৬২তম মিনিটে রদ্রিগেসের ফ্রি কিক থেকে ফিরতি বলে দূরপাল্লার শট নেন লের্মা। বারের অনেক ওপর দিয়ে চলে যায় বল।
এক মিনিট পর ডান পায়ের চোট ফিরে এলে মাঠে পড়ে যান মেসি। ফিজিও মাঠে ঢুকেই ইঙ্গিত করেন তাকে উঠিয়ে নেওয়ার। তার বদলে মাঠে নামেন নিকোলাস গনসালেস। কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়েন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক। ডাগ আউটে বসেও কাঁদতে থাকেন মেসি। ৭০তম মিনিটে চোট পান মন্টিয়েল। তার জায়গায় নামানো হয় নাহুয়েল মোলিনাকে।
পাঁচ মিনিট পর ডি-বক্সের ভেতর থেকে আলতো টোকায় বল জালে জড়ান গনসালেস। কিন্তু তাকে পাস দেওয়া তাগলিয়াফিকো অফসাইডে থাকায় মেলেনি গোল।
৭৯তম মিনিটে রদ্রিগেসের ক্রসে ডি-বক্সের মাঝ থেকে হেড লক্ষ্যে রাখতে পারেননি কার্লোস কুয়েস্তা। দুই মিনিট পর ডি-বক্সের বাইরে বাম পাশে পাওয়া ফ্রি-কিক রক্ষণ দেওয়াল বরাবর মারেন রদ্রিগেস।
৮৮তম মিনিটে ডান পাশ থেকে লম্বা ক্রস দেন দি মারিয়া। বাম পাশে পোস্টের কাছাকাছি থেকে লাফিয়ে হেড করেন গনসালেস। অল্পের জন্য দূরের পোস্ট ঘেঁষে বাইরে চলে যায় বল। সময়মতো কাছাকাছি আসতে না পারায় পা ছোঁয়াতে পারেননি আলভারেস।
যোগ করা সময়ের প্রথম মিনিটে কলম্বিয়া ডিফেন্ডারের ভুলে ডি-বক্সের মধ্যে বল পেয়ে যান দি মারিয়া। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শট করতে পারেননি জাতীয় দলের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলতে নামা অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার।
তৃতীয় মিনিটে দি মারিয়ার কর্নার কিক থেকে ক্রিস্তিয়ান রোমেরোর হেডে ডি-বক্সের মাঝে বল পান গনসালেস। কিন্তু তার শট চলে যায় বারের ওপর দিয়ে। মূল ম্যাচের শেষ দিকে দুটি সুযোগ হারিয়ে অতিরিক্ত সময়ে যায় আর্জেন্টিনা।
অতিরিক্ত সময়েম্যাচের ১১২ মিনিটের মাথায় ডি বক্সের সামনে থেকে লো সেলসো ফ্লিকে বল বাড়িয়ে দেন ডানদিকে থাকা লাওতারোকে। বল পেয়েই এই ফরোয়ার্ড ঢুকে পড়েন বক্সের মধ্যে। তার সামনে ছিলেন কেবল কলম্বিয়ার গোলরক্ষক ভার্গাস। তার মাথার উপর দিয়ে জোরালো শট নিয়ে বল জালে জড়ান ইন্টার মিলানের তারকা মার্টিনেজ।
এমজে/