আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মানুষকে পুড়িয়ে মেরে কিছু অর্জন করা যায় না, জনগণের কল্যাণ করে অর্জন করা যায়। যারা এগুলো করছে তাদের চেতনার বিকাশ ঘটবে এটাই আশা করি।
তিনি আরও বলেন, একাত্তর সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যেভাবে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে, এখনও সেভাবে মানুষ এবং যানবাহন পোড়ানো হচ্ছে।
মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) ঢাকা সেনানিবাসের আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত নির্বাচিত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা দেওয়া এবং ২০২২-২৩ সালে সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ শান্তিকালীন পদকপ্রাপ্ত সদস্যদের পদকে ভূষিতকরণ অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অগ্নিসন্ত্রাস দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। মানুষকে কীভাবে জ্বালিয়ে মারতে পারে, কীভাবে একটা মানুষকে পুড়িয়ে মারে। সাম্প্রতিক সময়েও এ অগ্নিসন্ত্রাস দেখছি। সবাইকে সচেতন হতে হবে। নানা চক্রান্ত চলছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অগ্নিসন্ত্রাস বা জ্বালাও-পোড়াও মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। আমি জানি না একটা মানুষ কীভাবে আরেকটা মানুষকে পুড়িয়ে মারে। একাত্তর সালে এমনটা দেখেছিলাম। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বস্তিতে আগুন দিত। মানুষ বের হলে গুলি করে মেরে ফেলে দিত। এরপর ২০১৩-১৪, আবার ইদানীং অগ্নিসন্ত্রাস শুরু হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আজ সেই পোড়া মানুষগুলো, তাদের পরিবার কী অবস্থায় আছে। এটা দুঃখজনক। এদের (অগ্নিসন্ত্রাসীদের) চেতনা হোক, সেটাই আমি চাই। অন্তত তাদের চেতনা ফিরে আসুক। মানুষকে পুড়িয়ে মেরে কোনো কিছু অর্জন করা যায় না। অর্জন করতে হলে জনগণের শক্তির দরকার হয়, জনগণের পাশে থাকতে হয়। জনগণের কল্যাণ করতে হয়। জনগণের অকল্যাণ করে, পুড়িয়ে মেরে কিছু অর্জন করা যায় না। যারা এসব করছে তারা যেন বুঝতে পারে।’
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সবাইকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। ২০২৬ সাল থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে অগ্রযাত্রা শুরু হবে। তার প্রস্তুতি আমরা নিচ্ছি। কিন্তু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। কেননা, নানা ধরনের চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র চলছে।’
১৫ বছরে বাংলাদেশের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আজ বাংলাদেশ পরিবর্তন হয়ে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। আমাদের উন্নয়নটা শুধু শহরভিত্তিক নয়, গ্রামে গ্রামে উন্নয়নের ছোঁয়া পৌঁছে দিতে পেরেছি। আমরা ট্রেনিং দিয়ে ছেলে-মেয়েদের দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে তুলছি। যাতে ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারি।
আমাদের সরকার হবে স্মার্ট সরকার। আমাদের সমাজব্যবস্থা হবে স্মার্ট সোসাইটি। বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সেটা ধরে রেখেই আমাদের উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার দিকে এগিয়ে যেতে হবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সরকারে আসার পর থেকেই আমার প্রচেষ্টা ছিল দলমত নির্বশেষে যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে, তাদের সম্মানিত করা। তাদের ভাতা দেয়া। তারা যেন গর্বের সঙ্গে বলতে পারে আমরা মুক্তিযোদ্ধা। আমরা তাদের ভাতার ব্যবস্থা করেছি। টাকাগুলো সরাসরি অ্যাকাউন্টে চলে যায়। এছাড়াও চিকিৎসা ভাতা, শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিচ্ছি। তিন কোটিরও বেশি শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পায়। এর বাইরেও আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের লক্ষ্যটাই হচ্ছে- এদেশে কোনো ভূমিহীন-গৃহহীন থাকবে না। আমরা ভূমিহীনদের ঘর, মুক্তিযোদ্ধাদের বীর নিবাস করে দিচ্ছি। মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোকে স্মরণীয় করে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। সবাইকে মনে রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। যে কাজই করি না কেন, আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা বীরের জাতি।
বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসার ঘটিয়ে আমরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব। আজকের বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটা ধরে রেখেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। উন্নত-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সবার সহযোগিতা কামনা করি।
’৭৫ এর হারাতে বসা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে তার সরকার আবার ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, যে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে লাখো বাঙালি স্বাধীনতার জন্য নিজের বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সেই স্লোগানও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। যে ৭ মার্চের ভাষণ এ দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করেছিল, সেই ভাষণও নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আজ সেই ভাষণ আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে স্থান পেয়েছে। আড়াই হাজার বছরে সামরিক-বেসামরিক নেতারা যত ভাষণ দিয়েছে, জাতির পিতার ৭ মার্চের ভাষণ তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে, এটুকু আমরা করতে পেরেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্নগুলো চিহ্নিত করা, যেখানে গণকবর আছে সেগুলো সংরক্ষণ করা, স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলার পাশাপাশি প্রত্যেকটি উপজেলায় আমরা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স তৈরি করেছি। সেখানে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতি ধরে রাখার জন্য মিউজিয়াম হবে। ইতিহাস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
সরকারপ্রধান বলেন, নতুন প্রজন্মকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও বীরত্বের ইতিহাস জানানো দরকার। স্বাধীনতা পেয়েছি বলেই আজকে আমরা নিজেদের পরিচয় দিতে পারি। কিন্তু একসময় সেটা পারিনি। এখন আমাদের স্বাধীন দেশে আমরা স্বাধীনভাবে চলতে পারি।
তিনি বলেন, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী শুধু দেশে নয়, বিদেশ শান্তিরক্ষা মিশনে বিরাট অবদান রেখে যাচ্ছে। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ইতোমধ্যে অনেকে জীবন দিয়েছেন। তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী সকালে সশস্ত্র বাহিনী দিবস-২০২৩ উপলক্ষ্যে ঢাকা সেনানিবাসে শিখা অনির্বাণে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর বীর শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধে খেতাবপ্রাপ্ত নির্বাচিত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীদের সংবর্ধনা দেওয়ার পাশাপাশি অনুষ্ঠানে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জন্য শান্তিকালীন কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ শান্তিকালীন পদক দেওয়া হয়।
এর আগে সকালে ঢাকা সেনানিবাসস্থ শিখা অনির্বাণে ফুল দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান তারা। এর আগে দিবসটিকে ঘিরে আলাদা বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী।
এমজে/