শার্দুল ঠাকুরের খাটো লেংথের বল মিড-অফের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ। সীমানার ঠিক আগে সেটি থামিয়ে ২ রানে আটকে রাখলেন বিরাট কোহলি। মিরাজ নিজে তো বটেই, গ্যালারির প্রায় ২৫ হাজার দর্শকের তখন অধীর অপেক্ষা আর একটি মাত্র রানের!
ইনিংসের শেষ বলটি মিড অনের দিকে আলতো করে ঠেলেই দৌড় শুরু করলেন মিরাজ। রান সম্পূর্ণ হতেই হেলমেট খুলে উচ্ছ্বাস। দুই হাত আকাশে তুলে সারলেন উদযাপন। যেন ডুব দিলেন ওই মুহূর্তটায়। অবিশ্বাস্য ব্যাটিংয়ে তিনি প্রথম ম্যাচে জিতিয়েছেন দলকে। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে শুধু আগের ম্যাচ নয়, ছাড়িয়ে গেলেন যেন আগের সবকিছু।
মিরপুর শের-ই বাংলা স্টেডিয়ামে বুধবার স্রেফ ৬৯ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছিল বাংলাদেশ। আট নম্বরে নেমে অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে প্রাথমিক ধাক্কা সামাল দিয়ে মিরাজ গড়েন ১৪৮ রানের রেকর্ড জুটি। পরে নাসুম আহমেদের সঙ্গে ঝড়ো ব্যাটিংয়ে দলকে নিয়ে যান লড়িয়ে সংগ্রহে।
মিরাজ এ দিন ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। তাকে থামানোর কোনো পথই বের করতে পারেনি ভারত। ১৯ ওভার শেষে যখন উইকেটে যান, দল তখন ধুঁকছে। ৫০ ওভার যখন শেষ হলো, তখন দল উড়ছে। মিরাজ তখন হাসছেন। তার নামের পাশে জ্বলজ্বল করছে ৮৩ বলে ১০০ রান। ইনিংসটি রাঙান তিনি ৮ চারের সঙ্গে ৪টি দৃষ্টিনন্দন ছয়ে।
তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি এটি। আটে নেমে ওয়ানডেতে বাংলাদেশের প্রথম সেঞ্চুরি।
ঘরের মাঠে ২০১৬ সালের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে পাঁচ ইনিংসে ৪ ফিফটিতে ২৪২ রান করেছিলেন মিরাজ। এর সঙ্গে ১২ উইকেট নিয়ে জিতেছিলেন টুর্নামেন্ট সেরার পুরস্কার। তখনও ব্যাটিং অলরাউন্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। কিন্তু সে বছর টেস্ট অভিষেকের সিরিজে ১৯ উইকেট নেওয়ার পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মূলত বোলার হিসেবেই পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।
তবু ব্যাট হাতে নিজের সামর্থ্য দেখানোর চেষ্টা প্রায়ই দেখা গেছে তার ব্যাটে। গত বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে পেয়েছেন টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি। এর বাইরে বেশ কিছু ফিফটির পাশাপাশি প্রায় নিয়মিতই কার্যকরী ৩০-৪০ রানের ইনিংস খেলে নিজের ব্যাটিং স্বত্বার জানান দিয়ে আসছেন তিনি।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ৪৫ রানে ৬ উইকেট পড়ার পর আফিফ হোসেনের সঙ্গে সপ্তম উইকেটে ১৭৪ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটিতে দলকে মনে রাখার মতো জয় এনে দিয়েছিলেন মিরাজ। প্রায় ১০ মাস পর ম্যাচের প্রথম ইনিংসে প্রায় একই পরিস্থিতি থেকে করলেন সেঞ্চুরি।
ওয়ানডে ইতিহাসে আট নম্বরে নেমে সেঞ্চুরির নজির আগে ছিল আর কেবল একটি। গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ডাবলিনের ম্যালাহাইডে ৯১ বলে ১০০ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন আয়ারল্যান্ডের অলরাউন্ডার সিমি সিং।
মিরপুর এই ম্যাচে শুরু থেকে ধুঁকে ধুঁকে এগোতে থাকা বাংলাদেশকে বড় ধাক্কা দেন ওয়াশিংটন সুন্দর। এই অফ স্পিনারের বলে সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম ও আফিফ হোসেনের উইকেট হারিয়ে চোখের পলকে ৩ উইকেটে ৬৬ থেকে বাংলাদেশের রান হয়ে যায় ৬ উইকেটে ৬৯। ব্যাটিংয়ে নেমে সেই ওয়াশিংটনের ওভারেই প্রথম ছক্কা মারেন মিরাজ।
উইকেটের চরিত্র বুঝে শুরু থেকেই সাবলিল ছিলেন তিনি। ইনিংসের ২৯তম ওভারে উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে ওয়াশিংটনের মাথার ওপর দিয়ে মারেন মেহেদী হাসান মিরাজ। অনেকটা পথ দৌড়েও নাগাল পাননি লং অনে দাঁড়ানো শার্দুল ঠাকুর।
তখনও দলের বিপদ পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় নন স্ট্রাইকে থাকা মাহমুদউল্লাহ কাছে গিয়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেন মিরাজকে। কিন্তু মিরাজের চোখেমুখে তখন পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের ছাপ। যেন শট খেলেই পরিণতি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। আগের ম্যাচে যেখানে শেষ করেছিলেন, এদিন যেন সেখান থেকেই খেলছিলেন মিরাজ।
অপরপ্রান্তে মাহমুদউল্লাহ ছিলেন দৃঢ়তার মূর্ত প্রতীক হয়ে। ইনিংসের ৩০ ওভার পেরোনোর আগেই দুজনের জুটিতে আসে ৫০ রান।
এরপর আর পেছনে তাকানো নয়। প্রথম ছক্কার দুই ওভার পর আকসার প্যাটেলকে স্লগ সুইপ করে ডিপ মিড উইকেটের ওপারে আছড়ে ফেলেন মিরাজ।
৩৮তম ওভারে উমরান মালিকের বলে ১ রান নিয়ে তিনি পূরণ করেন ক্যারিয়ারের তৃতীয় ফিফটি। পঞ্চাশ ছোঁয়ার পথে বাংলাদেশের চতুর্থ খেলোয়াড় হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ২ হাজার রান ও ২০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন মিরাজ। তার আগে এটি করেছেন মোহাম্মদ রফিক, মাশরাফি বিন মুর্তজা ও সাকিব আল হাসান।
দলের রান ২০০ পার করে শেষ হয় মাহমুদউল্লাহর লড়াই। তার বিদায়ে ভাঙে ১৪৮ রানের সপ্তম উইকেট জুটি। ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেতে যে কোনো উইকেটে বাংলাদেশের সেরা জুটি এটি। সপ্তম উইকেটে ওয়ানডে ইতিহাসে এর চেয়ে বড় জুটি রয়েছে স্রেফ দুটি।
নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১৫ সালে সপ্তম উইকেটে ১৭৭ রান যোগ করেছিলেন জস বাটলার ও আদিল রশিদ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আফিফ হোসেন ও মিরাজ গড়েন ১৭৪ রানের জুটি।
অভিজ্ঞ সঙ্গী ফেরার পর পুরো দায়িত্বটা নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি। অন্য প্রান্তে নাসুম আহমেদ ২ চার ও ১ ছয়ে মিরাজকে দেন নির্ভরতা। উমরান মালিকের করা ৪৯তম ওভারে তিন চারে ৮৫ রানে পৌঁছে যান মিরাজ। ছাড়িয়ে যান তার আগের সর্বোচ্চ ৮১ রানকে।
গ্যালারিতে তখন গর্জন, ‘মিরাজ, মিরাজ, মিরাজ।’ শার্দুল ঠাকুরের করা শেষ ওভারের প্রথম বলে নাসুম ১ রান নিতে আরও বাড়ে গ্যালারির আওয়াজ। সবাই তখন অপেক্ষায় মিরাজের সেঞ্চুরির। দ্বিতীয় বলে স্লোয়ার ডেলিভারিতে দারুণ স্লগ করে নব্বইয়ের ঘরে পা রাখেন মিরাজ। পরের বলে রান না হলেও চতুর্থ বলে আরেকটি ছক্কা। পৌঁছে যান সেঞ্চুরির আরেকটু কাছে।
শেষ দুই বলে ৩ রান নিয়ে নিজের ইনিংসকে তিনি দেন পূর্ণতা। ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে দুর্দান্ত ব্যাটসম্যানশিপের প্রদর্শনী মেলে ধরে যেন জানিয়ে রাখলেন, পরিপূর্ণ অলরাউন্ডার হতে তিনি তৈরি।