বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ হত্যার প্রকৃত কারণ এখনো অজানা। ৪ নভেম্বর রাত ১০টার পর থেকে ভোররাত পর্যন্ত তার ঘনঘন স্থান পরিবর্তনের বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
এ রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছেন তারা। তদন্তসংশ্লিষ্টদের ধারণা, রাজধানীর যে কোনো স্থানে অথবা নারায়ণগঞ্জে কয়েতপাড়া এলাকায় কিছু একটা ঘটেছে। এর জেরেই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
এছাড়া ফারদিনের লাশ উদ্ধারের কাছাকাছি সময় নারায়ণগঞ্জ থেকে আরেকটি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই লাশের সঙ্গে ফারদিন হত্যার কোনো যোগসূত্র আছে কিনা সেটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ শনিবার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রকৃত ঘটনা এখনো বের করতে পারিনি। ডিবির পক্ষ থেকে আমরা কখনো বলিনি, ফারদিন নারায়ণগঞ্জের চনপাড়ায় গিয়ে মাদকের কারণে মারা গেছেন।
আবার মামলার আসামি ফারদিনের বন্ধুকে আমরা গ্রেফতার করেছি, তিনিই খুন করেছেন, সেটিও কিন্তু আমরা বলছি না। আমরা পারিপার্শ্বিকতা, বিভিন্ন বিষয় বিচার বিশ্লেষণ করছি। আমাদের তদন্ত দল সব বিষয়, তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে চুলচেরা পর্যালোচনা করছে।
ডিবি প্রধান বলেন, ফারদিন ঢাকার কোনো এক জায়গায় খুন হতে পারেন বলে মনে হচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত এ ঘটনার কোনো সুনির্দিষ্ট ক্লু পাইনি। ফারদিনের মোবাইলের ডাটা অ্যানালাইসিস ও বিভিন্ন জায়গায় তিনি যার সঙ্গে কথা বলেছেন সবকিছু মিলিয়ে দেখছি। মোবাইলের লোকেশন নারায়ণগঞ্জেও পাওয়া গেছে।
মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, নিহতের বাবা প্রথমে একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। পরে তিনি মামলা করেন। মামলায় এক নম্বর আসামি বুশরাকে গ্রেফতার করেছি। পাশাপাশি মামলার এফআইআরে তার নাম আসায় আমরা মনে করছি না, তিনিই দায়ী। তাকে রিমান্ডে এনে আমরা কথা বলছি।
ঢাকা শহরে ফারদিন যেখানে যেখানে গিয়েছিলেন আমরা বিভিন্ন টেকনিক্যাল মাধ্যম ব্যবহার করে খুঁজে বের করেছি। তবে কোনো নিশ্চিত তথ্য বের করতে পারিনি। আমাদের কাজ চলছে। আশা করছি, শিগগিরই ঘটনার রহস্য বের করতে পারব।
এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মাদকের কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে কিনা জানতে চাইলে ডিবি প্রধান বলেন, আমরা কখনো বলিনি, ফারদিন মাদকের কারণে খুন হয়েছেন। তিনি কখনো মাদক সেবন করেছেন বলে আমরা তথ্য পাইনি। নারায়ণগঞ্জের চনপাড়া বস্তিতে ডিবির অভিযান চলছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে হারুন অর রশীদ বলেন, তদন্তের স্বার্থে শুধু চনপাড়া বস্তি কেন ডেমরা ও খিলগাঁওসহ সব জায়গায় ডিবির টিম কাজ করছে।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফারদিন ৪ নভেম্বর বেলা ৩টার দিকে বুয়েটের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন। এরপর থেকে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। ৫ নভেম্বর বিকালে তার বাবা নুরুদ্দিন রামপুরা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন। ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদী থেকে নৌপুলিশ সদস্যরা তার লাশ উদ্ধার করেন। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার হত্যা মামলা করা হলে পুলিশ ফারদিনের বান্ধবী বুশরাকে গ্রেফতার করে ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যুগান্তরকে বলেন, মৃত্যুর আগে ফারদিনের ওভারঅল মুভমেন্ট পর্যালোচনা করছি। কয়েতপাড়া এলাকায় তার লোকেশন কেন ছিল সেটি গভীরভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
রাতে তার বিভিন্ন স্থানে বিচরণের পাশাপাশি ফারদিনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিষয়টি নিয়ে কাজ চলছে। র্যাব পরিচালক বলেন, ফারদিন মৃত্যুরহস্য উদ্ঘাটনে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে। প্রযুক্তিগত তদন্তের পাশাপাশি ফারদিন যাদের সঙ্গে চলাফেরা করতেন তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ কর হচ্ছে।
দ্রুত বিচারের দাবিতে ফারদিনের সহপাঠীদের মানববন্ধন : ঢাবি প্রতিনিধি জানান, ফারদিন নূর পরশের মৃত্যুকে অস্বাভাবিক দাবি করে দ্রুত এর বিচার চেয়েছে তার সহপাঠী বন্ধুরা। শনিবার বিকালে বুয়েটের শহিদ মিনারের পাশে আয়োজিত মানববন্ধনে এই দাবি জানান।
মানববন্ধনে ফারদিনের এক সহপাঠী বলেন, রাজধানীর মতো একটা জায়গায় একজন শিক্ষার্থী ৩ দিন নিখোঁজ ছিল। জিডি করার পরও কেন তার ট্রেস (সন্ধান) পাওয়া যায়নি, এ বিষয়টা ক্ষুব্ধ হওয়ার জন্য যথেষ্ট। দেশে এভাবে কেন মানুষ মারা যাবে? এটা কেন হবে, ওই জায়গা থেকে আমাদের একটা প্রতিবাদ করার জায়গা আছে। মানববন্ধনে বুয়েটের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, প্রশ্ন হতে পারে, আমরা পুলিশের ওপর শতভাগ বিশ্বাস রাখতে পারছি না। আমরা এটা বলার জন্য ওয়েল ইকুয়েপ্ট না। আমরা তদন্তের ওপর আস্থা রাখছি। আমরা আশা করি, পুলিশ হয়তো আমাদের নিরাশ করবে না।
বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার পর ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন অধিকাংশ শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীরা আবরারকে নিয়ে একটা আর্কাইভ ওয়েবসাইটও তৈরি করেন।
সেখানে ফারদিনেরও অংশগ্রহণ ছিল বলে অনেকের দাবি। সেই দিক থেকে রাজনৈতিক কারণে ফারদিন হত্যার শিকার হয়েছেন কিনা এমন প্রশ্নে আরেক সহপাঠী বলেন, আবরার হত্যা হওয়ার পর ও সোচ্চার ছিল ঠিক আছে, ওইটা আমাদের কারেন্ট স্টুডেন্টদের সবার মধ্যেই ছিল।
ওর যে পোস্টটা ভাইরাল হয়েছে, বুয়েটে কোনো ছাত্র রাজনীতি নয়। ওই পোস্ট আমাদের কারেন্ট স্টুডেন্টদের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী সবাই শেয়ার করেছিল। তিনি আরও বলেন, সে (ফারদিন) ডিবেট ক্লাবে ছিল, ওর মধ্যে একটা সচেতনতা ছিল। ছাত্র রাজনীতির বিরুদ্ধে বুয়েটের সবাই কনশাস (সচেতন) ছিল।
পলিটিক্যাল সোচ্চার ব্যক্তির চেয়ে সে আসলে বই, সিনেমা, ফিলোসফি বা জ্ঞানের দিক থেকে তাকে আরও ভালো মতো ডিফাইন করা যায়। রাজনৈতিক ইস্যুতে সে অন্যদের চেয়ে লাউড ছিল না। মানববন্ধন শেষে তারা পলাশী মোড়ে ‘ক্যাম্পাস নিরাপদ, কিন্তু রাষ্ট্র?’, ‘হাউ টু সারভাইভ ইন দিজ কান্ট্রি?’, ‘নিরাপদ জীবনের নিশ্চয়তা চাই’, ‘সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের নিশ্চয়তা চাই’ লেখা সংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদ জানান।