বিদেশে অর্থ পাচার বন্ধে অনলাইনে জুয়া ও ক্যাসিনো কর্মকাণ্ড মানি লন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ত অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। পাশাপাশি সাইবার অপরাধ ও পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে অর্জিত টাকা পাচার একই দোষে দোষী সাব্যস্ত হবে।
এ লক্ষ্যে বিদ্যমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের বিধিমালা এবং দ্য পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭ সংশোধন করা হচ্ছে। ‘মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা এবং নীতিসমন্বয় ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় সমন্বয়’ কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আর এ সংক্রান্ত খসড়া প্রণয়ন করতে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি), জননিরাপত্তা বিভাগ ও লেজিসলেটিভ বিভাগকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
এর আগে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট বা বিএফআইইউ) একই উদ্যোগ গ্রহণ করে। এটি কার্যকর করতে ওই সময় একটি কমিটিও গঠন হয়। কিন্তু সে উদ্যোগ অদ্যাবধি কার্যকর হয়নি। ফলে অনলাইনে জুয়ার মাধ্যমে অর্জিত অর্থ পাচার প্রতিরোধ এবং মামলার শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
জানতে চাইলে বিএফআইইউ সাবেক উপদেষ্টা দেবপ্রসাদ দেবনাথ যুগান্তরকে জানান, মানি লন্ডারিং আইনে ২৭টি অপরাধের ধরন উল্লেখ আছে। এর বাইরেও কোনো অপরাধের মাধ্যমে অর্জিত টাকা বিদেশে পাচার করলে সেটি এ আইনে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে। সেটি সাইবার অপরাধ বা অনলাইনে জুয়া, যাই হোক দেশের ভেতর অপরাধ কার্যক্রম পরিচালন করে অর্জিত অর্থ মানি লন্ডারিং করা হলে বিদ্যমান মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে যুক্ত করা যাবে।
জানা যায়, ২০২০ সাল থেকে দেশে অনলাইন জুয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব সাইটের আসক্তি ও গ্রাহকও বাড়ছে। ফলে অবৈধভাবে অর্থ লেনদেন ও দেশের অর্থ পাচার হচ্ছে। সম্প্রতি এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বিশেষ করে অনলাইন জুয়া ‘তিন পাত্তি গোল্ডের’ নামে একটি মাধ্যমে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার করা হয়। একইভাবে পাচার করেছে ‘বেটউইনার’ নামে অনলাইন জুয়া সাইড। এদের মতো অসংখ্য অনলাইনভিত্তিক জুয়া কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করছে একাধিক চক্র। সে অর্থ হুন্ডিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পাচার করা হচ্ছে দেশের বাইরে। অনলাইন জুয়ার সাইট ও অ্যাপগুলো মূলত বিদেশে বসে পরিচালনা করা হয়। তবে কার্যক্রম দেখভালের জন্য রয়েছে দেশীয় এজেন্ট।
তারা গ্রাহক সংগ্রহ, জুয়ার টাকা হুন্ডিসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বিদেশে পাচার করছে। গত কয়েক বছরে অনলাইন বেটিং সাইটগুলোর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা পাচারের প্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে প্রাথমিক তথ্য পেলেও অনুসন্ধান ও অর্থ পাচার মামলার অগ্রগতি নেই। কারণ এসব ঘটনা মানি লন্ডারিং আইনে সম্পৃক্ততা নেই। অনলাইনে জুয়া এবং অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার, ক্যাসিনো কর্মকাণ্ডসহ অর্থ পাচারের নানা ইস্যু আলোচনায় উঠে আসে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠকে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে দীর্ঘ প্রায় তিন বছর পর মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, আইন সচিব, জননিরাপত্তা বিভাগ সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), দুদকের চেয়ারম্যান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব, অ্যার্টনি জেনারেল, বিএফআইইউ প্রতিনিধি অংশ নেন। ওই বৈঠকে বিএফআইইউ-এর পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০১৯ সালের ৯ জুলাই অনলাইনে জুয়া, ক্যাসিনো কর্মকাণ্ড, সাইবার অপরাধ, পর্নোগ্রাফির ঘটনা মানি লন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ত অপরাধ হিসাবে গণ্য করার প্রস্তাব আসে।
ওই সময় প্রস্তাব পর্যালোচনা করে একটি সুপারিশমালা উপস্থাপন করা হয় ওয়ার্কিং কমিটির কাছে। পরবর্তীকালে এর আইনগত দিক খতিয়ে দেখতে ২০২১ সালের ২ মার্চ লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগকে আহ্বায়ক এবং বিএফআইইউকে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে আরও ছিল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ পুলিশের সিআইডি, তথ্য যোগাযোগ ও প্রযুক্তি বিভাগ, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন।
সরকারি গঠিত ওই কমিটি এ বিষয়ে তিনটি বৈঠক করে একটি সুপারিশমালা প্রণয়ন করে। এরপর ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর তা প্রতিবেদন আকারে জমা দেওয়া হয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে। আর চলতি বছরের ২২ মার্চ বিএফআইউ-এর ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকেও এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। সেখানে আরও বলা হয়, ওয়ার্কিং কমিটি এসব সুপারিশ পর্যালোচনা করে সাইবার অপরাধ এবং পর্নোগ্রাফিকে মানি লন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ত অপরাধ হিসাবে গণ্য করার পক্ষে মত দেয়।
পাশাপাশি দ্য পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭ এবং ঢাকা মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ ১৯৭৬ সংশোধনের মাধ্যমে জুয়া, অনলাইনে জুয়া ও ক্যাসিনো কর্মকাণ্ড কঠোর শাস্তির বিধানকে যুক্তসহ মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ আওতায় অপরাধ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। এরপর এ ব্যাপারে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।