জাতীয় ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি) পক্ষপাতহীনভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তাদের সতর্ক করে বলা হয়েছে, এমন কোনো কাজ করবেন না যাতে মানুষ মনে করে আপনারা দলনিরপেক্ষ নন। মাঠ কর্মকর্তাদের কাজ নির্বাচন কমিশন পর্যবেক্ষণ করবে। ইসি বলেছে, দায়িত্ব পালনে কোনো শৈথিল্য সহ্য করা হবে না। ইসি তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন ও ক্ষমতা প্রয়োগে কঠোর অবস্থানে থাকবে। শনিবার দেশের সব জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনাররা এমন বার্তাই দিয়েছেন। নির্বাচনের সময়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের রাজনৈতিক কারণে হয়রানি না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। জাতীয় নির্বাচনে সাবেক বা বর্তমন মন্ত্রী-এমপিদের কেউ প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করলে তা নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়। সভায় জেলা পরিষদ নির্বাচনে আচরণ বিধিমালা লংঘন নিয়ে ইসির হাতে অনেক অভিযোগ থাকার কথাও তাদের জানানো হয়। এক কমিশনারের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ডিসি-এসপিরা হইচই শুরু করেন। এ কারণে তিনি বক্তব্য শেষ করতে পারেননি। বৈঠক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। জানা গেছে, ওই সভায় ডিসি-এসপিরা তাদের বক্তব্যে বেশ কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরেন। একই সঙ্গে কয়েকটি বিষয়ে তাদের পরামর্শও দেন। আগামী নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা কমিয়ে বুথের সংখ্যা বাড়ানো, কেন্দ্র নির্ধারণে ডিসি, এসপি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব দেন তারা। এছাড়া গ্রামে ইভিএম ব্যবহার হলে ভোটারদের ভোট দিতে অসুবিধার কথা বিবেচনায় নিয়ে শহরের আসনে এ মেশিনে ভোটের কথা বলেন। একই সঙ্গে ইভিএম নিয়ে ব্যাপক প্রচারের পরামর্শও দেন। একই সঙ্গে নির্বাচনে গণ্ডগোল হলে তা নিয়ন্ত্রণে কমান্ড কে করবেন-তা নির্ধারণ করে দিতে ইসিকে অনুরোধ জানান। নির্বাচনে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানান কয়েকজন ডিসি ও এসপি। মাঠ কর্মকর্তারা ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবেন বলেও কমিশনকে আশ্বস্ত করেন।
জাতীয় সংসদের দুটি আসনের চলমান উপনির্বাচন এবং জেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচন সামনে রেখে শনিবার রাজধানীর নির্বাচন ভবনের অডিটোরিয়ামে রুদ্ধদ্বার এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে চারজন নির্বাচন কমিশনার, ইসির সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও পুলিশের আইজির পক্ষে অতিরিক্ত আইজিপি উপস্থিত ছিলেন। কোভিড পজিটিভ হওয়ায় আইজিপি এ সভায় উপস্থিত ছিলেন না। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল অনুষ্ঠানে সভাপতি ছিলেন। তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলা এ বৈঠকে ২৫ জন ডিসি-এসপি বক্তব্য দেন। বৈঠকের পর সিইসি ও জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব আলাদা সংবাদ সম্মেলন করে সভায় আলোচনার বিষয়বস্তু সাংবাদিকদের জানান।
সূত্র জানায়, নির্বাচনে বরাদ্দ বাড়াতে কয়েকজন ডিসি দাবি জানালেও চলমান জেলা পরিষদ নির্বাচনে আচরণবিধি লংঘন নিয়ে বক্তব্য না রাখায় হতাশা ব্যক্ত করেন এক নির্বাচন কমিশনার। তিনি অভিযোগ করেন, অনেক ডিসি ও এসপি স্থানীয় সংসদ সদস্যদের কথামতো কাজ করেন। এ কারণে আচরণবিধি লংঘনে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। নির্বাচনে ম্যাজিস্ট্রেটদের যাতায়াতে যে জ্বালানি দেওয়া হয় তার খরচের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তার এ বক্তব্যের পরই হইচই করেন ডিসি ও এসপিরা। তখন ওই নির্বাচন কমিশনার সভায় জানান, তার কাছে স্পষ্ট প্রমাণ আছে। এরপরও হইচই চলতে থাকে। এরপর তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, তার বক্তব্য ডিসি-এসপিরা শুনতে চান কিনা? এর জবাবে না উচ্চারণ হলে তিনি বক্তব্য শেষ না করে নিজের আসনে গিয়ে বসেন।
সূত্র জানায়, বৈঠকের কার্যপত্রে চলমান ও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যালোচনা, নির্বাচনে সম্ভাব্য দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা এবং নির্বাচনি আইন ও বিধিমালা প্রতিপালনসহ ৬টি বিষয় আলোচ্যসূচি হিসেবে রাখা হয়। এতে মন্ত্রী, এমপিসহ সবাইকে আচরণ বিধিমালা প্রতিপালনের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। একই সঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার ও ইসির কর্মপরিকল্পনার সারসংক্ষেপ ডিসি-এসপিদের সামনে তুলে ধরা হয়।
নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ: সভা শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। ডিসি-এসপিদের উদ্দেশে দেওয়া নির্দেশনাগুলো তুলে ধরেন তিনি । সিইসি বলেন, ডিসি এসপিদের বলা হয়েছে তারা যেন অবশ্যই দল নিরপেক্ষ হয়ে কাজ করেন। আপনারা একইসঙ্গে সরকারি কর্মচারি । গণকর্মচারী হিসেবে সরকার ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। কখনো নিজেদের দলীয় কর্মী ভাববেন না বা মনে করবেন না। আপনাদের আচরণে এমন কিছু যেন প্রতিফলিত না হয় যাতে জনগণ মনে করে আপনারা কোন দলের পক্ষ হয়ে কাজ করছেন। কর্মকর্তাদের হুশিয়ার করে দিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় ইসির অবস্থান থাকবে কঠোর। মাঠ কর্মকর্তাদের কাজও পর্যবেক্ষণ করা হবে। দায়িত্ব পালনে কোনো শৈথ্ল্য সহ্য করা হবে না। ইসি তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন ও ক্ষমতা প্রয়োগে কঠোর অবস্থানে থাকবে।
তিনি বলেন, আমাদের জেলা ও পুলিশ প্রশাসন নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে চেষ্টা করে। তারপরও অনেক সময় অলক্ষে প্রভাব চলে আসতে পারে। তবে কোন ক্ষেত্রে ব্যত্যয় হলে আমরা বলেছি আপনাদের কর্মে কোন শৈথিল্য থাকবে না। নির্বাচন কমিশন কিন্তু এবার শক্ত অবস্থানে থাকবে। আচরণ বিধি মেনে গণকর্মচারী হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। দলীয় কর্মী হিসেবে নয়, সরকারি কর্মচারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমরা সেটা পর্যবেক্ষণ করবো। সিইসি বলেন, নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও এর অধীনে এনফোর্সমেন্ট বাহিনী প্রয়োজনে সেনাবাহিনীও ইসির অধীনে থাকবে। আমাদের যে কোন নির্দেশনা মানতে তারা বাধ্য থাকবে। অবাধ্য হলে আমাদের করণীয় দেখবো। ডিসি-এসপিরা নিরপেক্ষ আচরণ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এতে সংসদ নির্বাচনে জনগণের আগ্রহ, আস্থা ও অংশগ্রহণ উৎসাহিত হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনের সময়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নিয়ে যেন কাউকে হয়রানি করা না হয় সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এটাই শেষ সভা নয়। আরও অনেকগুলো মিটিং হবে। নির্বাচনের এখনও এক বছর দুই মাস সময় আছে। বিএনপির নেতাকর্মীদের তালিকা করার বিষয়ে জানতে চাইলে সিইসি বলেন, আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। এ বিষয়ে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেব না। বর্তমান প্রশাসন দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন করা সম্ভব কিনা-এমন প্রশ্নেরও জবাব দেননি তিনি।
সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া ও ইসির প্রতি আস্থা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিভাজন থাকলেও তা রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে বলে জানান সিইসি। তিনি বলেন, সংসদ নির্বাচন নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ অবস্থানের কারণে বিভাজন রয়েছে। আমরা আশা করি রাজনৈতিক নেতৃত্ব তাদের সদিচ্ছা, প্রজ্ঞা দিয়ে রাজনৈতিক সমস্যাগুলোর সমাধান করবেন। আর এই কাজটিও কমিশনের নয়। রাজনৈতিক বিষয়ে ইসি অনুপ্রবেশ করতে পারে না। রাজনৈতিক সমস্যা রাজনীতিকদের সমাধান করতে হবে।
এর আগে সভায় নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোঃ আহসান হাবিব খান দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যের কেউ প্রভাব বিস্তার করলে তা নিয়ন্ত্রণ করতে ডিসি-এসপিদের নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের সময় অনেক প্রভাবশালী মহল বা রাজনৈতিক দলের নেতা, সাবেক ও বর্তমান মন্ত্রী, এমপিসহ নানা মানুষ এলাকায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নির্বাচনের সময় পেশিশক্তি, অর্থশক্তি ও ক্ষমতা প্রদর্শনের চেষ্টা করে। কালো টাকার ব্যবহারের কথাও শোনা যায়। আপনারা চোখ খান খোলা রেখে এই বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করবেন। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনের আগে পরে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের পক্ষ বা বিভিন্ন মহল থেকে নানা ধরনের গুজব বা অপপ্রচার ছড়ায় এবং অনেক মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে বিশৃংখল পরিস্থিতি তৈরীর চেষ্টা করে। আপনারা এ বিষয়ে সতর্ক থাকবেন। কোনো গুজবের সন্ধান পেলে বা এরকম পরিস্থিতি তৈরী হলে আপনারা দ্রুত গুজবকারীদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেবেন। সোস্যাল মিডিয়ায় কোনো গুজব ছড়ায় কী না- তা মনিটরিং করা এবং নির্বাচনে নীতিমালা অনুযায়ি খবর সংগ্রহে সাংবাকিদদের পেশাগত কাজে সহায়তার নির্দেশ দেন।
কেন্দ্র কমিয়ে বুথ বাড়ানোর পরামর্শ: বৈঠকের পর ইসির মিডিয়া সেন্টারে জনরিাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোঃ আখতার হোসেন ও অতিরিক্ত আইজিপি আতিকুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করেন। বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে মোঃ আখতার হোসেন বলেন, আগামী নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র বেড়ে ৪৩ হাজারের বেশি হবে। যে জায়গাগুলাতে সুরক্ষিতভাবে ভোটগ্রহণ করা যাবে সেগুলোা রেখে অপ্রয়োজনীয় ভোটকেন্দ্র বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করেছি; যাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঠিকভাবে মোতায়েন করা যায়। একটি ইউনিয়নে ৯-১০টি বা তার থেকেও বেশি ভোট কেন্দ্র রয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রের যে সংখ্যা তাতে পর্যাপ্ত সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা যায় না। এজন্য আমরা চাচ্ছি ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা কমিয়ে বুথ বাড়িয়ে দেয়ার জন্য।
ভোটকে কেন্দ্র করে অনেক জায়গায় সামাজিক গুজব তৈরি হচ্ছে উল্লেখ করে সিনিয়র সচিব বলেন, এগুলো আমরা মাঠপ্রশাসনকে দেখতে বলেছি। যেখানে প্রশ্নের উদ্বেগ হয়, সেখানেই যেন তারা কাজ করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠ প্রশাসনে রদবদল হয় না। এটি রুটির ওয়ার্ক। কিছুদিন আগে পদোন্নতির কারণে আমরা ৪০টি জেলায় নতুন এসপি নিয়োগ দিয়েছি। তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে বলেছি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, হয়রানিমুলক মামলার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়নি। তবে হয়রানিমুলক মামলার সুযোগ নেই। আমরা কখনো এ ধরনের নির্দেশ দেবো না। এ সময় তার পাশে থাকা পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি বলেন, নির্বাচনের সময় ইসির অধীনে পুলিশ প্রশাসন কাজ করে থাকে। পুলিশ নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার আলোকে পুলিশ দায়িত্ব পালন করে। কারো বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুলিশের ভূমিকা ২০১৮ সালের নির্বাচনের মত থাকবে কী না এমন প্রশ্নের তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন আমাদেরকে যেভাবে দায়িত্ব পালন করতে বলেন। সেইভাবে দায়িত্ব পালন করবো। ভোটকেন্দ্র কমানোর পরামর্শের বিষয়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, নির্বাচনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সংযোগ রয়েছে। তারা বলেছেন ভোট কেন্দ্রগুলো রিঅ্যারেঞ্জ করা হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ভোটারদের জন্য আরো সহজতর হতে পারে। আমরা তাদের এই প্রস্তাব নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবো, পর্যালোচনা করবো।
বৈঠকে আরও যা আলোচনা: বৈঠক সূত্র জানায়, একটি জেলার পুলিশ সুপার নির্বাচনে পথসভার স্থান নির্দিষ্ট করার প্রস্তাব দেন। বরিশাল অঞ্চলের একজন ডিসি মাদ্রাসায় ভোটকেন্দ্র স্থাপন না করার পরামর্শ দেন। কয়েকজন ডিসি ও এসপি নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়ার নির্দেশনা চান।
ইউআর/