বড় সংশোধন হচ্ছে না আরপিও’র

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে, ১৯৭২ (আরপিও) বড় সংশোধনী আনার প্রস্তাব থেকে সরে গেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এমনকি আরপিও ইংরেজি থেকে বাংলা ভাষায় আইন প্রণয়নের কার্যক্রম অনেকটা এগোলেও তা বাদ দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।

নির্বাচনে ঋণ ও বিলখেলাপিদের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে নতুন বিধান যুক্তের প্রস্তাব উপস্থাপনের পর আপত্তির মুখে সেখান থেকেও সরে এসেছে ইসি সচিবালয়। আইন সংস্কারের বিষয়ে বিগত কেএম নূরুল হুদা কমিশনের যেসব সুপারিশ ছিল, সেগুলো থেকেও কিছু বাদ দেওয়া হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিদ্যমান আরপিওতে যে সংশোধনীগুলো না আনলেই নয়, শুধু সেসব ধারা সংশোধনের প্রস্তাব করতে যাচ্ছে বর্তমান কমিশন। এতে ভোটকেন্দ্রে পেশিশক্তির ব্যবহারসহ অনেক অসঙ্গতি অধরাই থেকে যাচ্ছে। কমিশনের আগামী সভায় আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করার জন্য উত্থাপন করা হতে পারে। ইসি সচিবালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, আইন সংস্কার কমিটি কয়েক দফার বৈঠকে আরপিওতে বেশ কিছু সংশোধনীর বিষয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু সম্প্রতি কমিশন থেকে আইন সংস্কার কমিটিকে আরপিওতে যতটুকু সংস্কার না আনলেই নয়, সেটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কমিশন মনে করছে, আরপিওতে বড় ধরনের সংশোধনীর প্রস্তাব করা হলে তা জাতীয় সংসদে পাশ নাও হতে পারে। অথবা আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ মেয়াদের জন্য ঝুলে যেতে পারে। এতে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে। প্রসঙ্গত, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৩ সালের শেষের দিকে অথবা ২০২৪ সালের প্রথমদিকে অনুষ্ঠিত হবে।

নির্বাচন কমিশন ও ইসির আইন সংস্কার কমিটির আহ্বায়ক বেগম রাশেদা সুলতানা যুগান্তরকে বলেন, আরপিওতে যতটুকু ছোটখাটো সংশোধন আনা প্রয়োজন, ততটুকুই আনা হবে। যেসব সংশোধনী এখনই না আনলেও চলে, সেগুলোতে আমরা হাত দেব না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, একটি সার্কুলারের কারণে আরপিও বাংলা আইনে রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছি। আর স্টেকহোল্ডারদের

আপত্তির কারণে ঋণ-বিলখেলাপিদের বিষয়ে যে সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হয়েছিল তাও বাদ দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, ইসি আরপিওতে যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব করতে যাচ্ছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, কোম্পানির পরিচালাক, ফার্মের অংশীদাররা বড় ধরনের ঋণখেলাপি হলে তাদের প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া। বর্তমানে মনোনয়নপত্র দাখিলের অন্তত সাত দিন আগে ঋণখেলাপির তালিকা থেকে বের না হতে পারলে তার প্রার্থিতা বাতিলের বিধান রয়েছে। ইসির সংশোধনী প্রস্তাবে আরপিওর ১২(১)১(এন) উপধারায় মনোনয়নপত্র দাখিলের আগের সাত দিনের মধ্যে খেলাপি ঋণ পরিশোধ বা পুনঃতফসিল করাতে পারলে প্রার্থিতা বহাল থাকবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, কৃষি, ক্ষুদ্রঋণ এবং বিল (টেলিফোন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও সেবা প্রদানকারী সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিল) বকেয়ার ক্ষেত্রে যে বিধান রয়েছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে এ সংশোধনীর প্রস্তাব করা হচ্ছে। যদিও সাবেক সিইসি কেএম নূরুল হুদা কমিশনের প্রস্তাবে এ সংশোধনীর বিষয়টি ছিল। একই ধরনের সংশোধনী এ কমিশন করতে যাচ্ছে।

জানা গেছে, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ‘অর্থ ঋণ আদালত আইন, ২০০৩’ এবং বিলখেলাপিদের বিরুদ্ধে ‘সরকারি পাওনা আদায় আইন, ১৯১৩’-এর অধীনে সার্টিফিকেট মামলা বা দেওয়ানি আদালতে মামলা থাকলে তারা নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে অযোগ্য হবেন এমন বিধান যুক্ত করে আরপিও সংশোধনের প্রস্তাব করেছিল। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, অন্যান্য ব্যাংক, সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা ইসির প্রস্তাবের বিরোধিতা করায় ওই সংশোধনী থেকে সরে এসেছে কমিশন।

সূত্র জানায়, আরপিওতে আরও যেসব সংশোধনীর প্রস্তাব করা হচ্ছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে-সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের আয়কর সনদ জমা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এজন্য আরপিওর ১২(৩এ)(সি) এবং ৪৪এএ(২)(এ)উপধারায় সংশোধনের প্রস্তাব করা হচ্ছে। বিগত কমিশনও এই সংশোধনীর প্রস্তাব করেছিল।

এছাড়া রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয়সহ সব পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ নারী নেতৃত্ব রাখার সময়সীমা ২০২০ সাল থেকে বাড়িয়ে ২০৩০ সাল প্রস্তাব করা হচ্ছে। এজন্য আরপিওর ৯০(বি) ধারায় সংশোধনী আনার প্রস্তাব করা হচ্ছে। এই প্রস্তাবটিও বিগত কমিশন করেছিল। সেই প্রস্তাবই আবারও পাঠাতে যাচ্ছে বর্তমান কমিশন।

এছাড়া আরপিওর ৭ ধারায় বিদ্যমান করণিক ত্রুটি দূর করতে ‘জেলা’ শব্দের পর ‘সংসদীয় আসন’ শব্দ যুক্তের প্রস্তাব করা হচ্ছে। এছাড়া কিছু ছোটখাটো সংশোধনী আনা হতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিভিন্ন মহলের আপত্তি ও সমালোচনার মুখে মেয়াদের শেষ সময়ে ২০২১ সালের ২৫ অক্টোবর কমিশনের এক সভায় আরপিওতে আটটি সংশোধনীর প্রস্তাব অনুমোদন করে তা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল তৎকালীন ইসি। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর মার্চ মাসে ওই সংশোধনীতে সংযোজন-বিয়োজন থাকলে তা প্রস্তাব করতে নির্বাচন কমিশনে ফেরত পাঠায় আইন মন্ত্রণালয়। ওই চিঠি পেয়ে আরপিওতে সংশোধনীর কাজ শুরু করে কমিশন।

বাদ যাচ্ছে অনেক সংশোধনী : ইসি সচিবালয় সূত্র জানায়, বিগত কেএম নূরুল হুদা কমিশনের মতো বর্তমান কমিশন আরপিও বাংলায় আইন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আইন মন্ত্রণালয়ের আপত্তির মুখে নূরুল হুদা কমিশনের ওই সংশোধনী পাশ হয়নি। বর্তমান কমিশন ওই প্রস্তাব পাঠানোর আগেই নিজ থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভোটকেন্দ্রে পেশিশক্তি ব্যবহার প্রতিরোধে আরপিওতে ২৫(এ) ও ৮৪(এ) উপধারা সংযোজনের প্রস্তাব করার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বর্তমান কমিশন।

এতে নির্বাচনে দায়িত্বপালনকারী কর্মকর্তাদের কাজে বাধা দিলে বা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাকে সাজার আওতায় আনার বিধান যুক্তের কথা ছিল। কিন্তু ওই প্রস্তাব থেকেও সরে আসছে ইসি। এছাড়া ৮০ বছরের বেশি বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেছিল বিগত কেএম নূরুল হুদার কমিশন। আরপিওতে ওই সংশোধনীর প্রস্তাব বাদ দিচ্ছে বর্তমান কমিশন।

ইউআর/

- Advertisement -spot_img
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ

- Advertisement -spot_img

এই বিভাগের আরও

- Advertisement -spot_img