স্থল সীমান্তে বাড়ছে সোনা পাচার

বাংলাদেশ থেকে স্থল সীমান্ত দিয়ে ভারতে সোনা পাচার বাড়ছে। নির্বিঘ্নে পাচারের জন্য অভিনব কৌশল নিচ্ছে পাচার চক্রের সদস্যরা। এরা কখনো কৃষক, দিন-মজুর, ট্রাক-লরির চালক, খালাসি, রাখাল, জেলে সেজে সোনা পাচার করছে।

টিফিন বক্স, মৌসুমি ফলের ঝুড়ি, সবজি ও মানব শরীরে সোনা পাচারের সময় হরহামেশাই গ্রেফতারও হচ্ছে। দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীরা সোনা পাচারের বিষয়টি স্বীকার করছেন। তাদের মতে সোনার দাম বাড়লেই পাচারও বৃদ্ধি পায়।

চলতি বছরের জুনে বাংলাদেশ থেকে স্থল পথে ভারতে পাচার ৩৩ কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়েছে। সম্প্রতি পেট্রাপোল এলাকায় বিএসএফ ১১ কেজি এবং বেনাপোল বিজিবি ১৫ কেজি সোনা জব্দ করেছে। এছাড়া ২০২০ সালে ৩৩ কেজি, ২০২১ সালে ৩০ কেজি সোনা উদ্ধার হয়।

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজি) অতুল ফুলেঝেলে গত ৩০ জুন বলেছেন, বাংলাদেশ সীমান্ত হয়ে ভারতে সোনা চোরাচালান বাড়ছে। এদিন তিনি কলকাতায় বাংলাদেশি সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেন। তিনি জানান, দামের পার্থক্যের কারণে বাংলাদেশ থেকে ভারতে সোনা চোরাচালান বৃদ্ধি পায়। এটা প্রতিরোধে তারা জোরালোভাবে কাজ করছেন।

তিনি বলেন, চোরাই পথে বাংলাদেশ থেকে সোনা আসছে। ভারত থেকে যাচ্ছে গবাদি পশু, ফেনসিডিল, রুপার অলংকার। সোনা চোরাচালান রোধে সীমান্তে আমরাও বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছি। দিন-রাত সতর্কাবস্থায় থাকছেন সীমান্তরক্ষীরা। এক প্রশ্নের জবাবে বিএসএফের আইজি অতুল ফুলেঝেলে বলেন, সোনার চালান এবং উদ্ধার দুটোই বাড়ছে। আমরা সতর্কাবস্থায় আছি। আমাদের তৎপরতা মূলত ‘ক্যাচিং’, ‘ডিটেকশন’ ও ‘প্রিভেনশন ইন্টেলিজেন্স বেজড’।

আমাদের সতর্ক গোয়েন্দা ব্যবস্থা দিয়ে আমরা এখন অনেক চালান ধরতে পারি। রাতের অন্ধকারে চোরাকারবারিদের শনাক্ত করতে পারছি। অবৈধ মালামালসহ গ্রেফতার করতে পারছি’। তিনি আরও বলেন, নিশ্চয় সোনা চোরাকারবারিরাও বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে। আমরাও সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থেকে দায়িত্ব পালন করছি।

সম্প্রতি পেট্রাপোলে আমরা (বিএসএফ) প্রায় ১১ কেজি সোনা জব্দ করেছি। একই সঙ্গে বেনাপোলে বিজিবি ১৫ কেজি সোনা জব্দ করেছে। এতে বোঝাই যাচ্ছে, সোনা চোরাচালান প্রবণতা বাড়ছে। আমরা ২০২০ সালে ৩৩ কেজি সোনা উদ্ধার করেছি। ২০২১ সালে কোভিড মহামারির মধ্যে ৩০ কেজি সোনা উদ্ধার করেছি। চলতি ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত আমাদের উদ্ধার করা সোনার পরিমাণ ৩৩ কেজি ছাড়িয়ে গেছে।’

বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির যশোর রিজিয়নের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ওমর সাদী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বাংলাদেশের বেশির ভাগ সোনা চোরাচালান হয় আমার এলাকা দিয়ে। আমরা এটা প্রতিরোধের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। প্রায়ই সোনাসহ চোরাকারবারিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। বুধবার (২৭ জুন) সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের বিপরীতে ভারতের ঘোজাডাঙ্গায় বসে ওমর সাদী এসব কথা বলেন। সেদিন ঘোজাডাঙ্গায় বিজিবি-বিএসএফ জোয়ানদের মধ্যে প্রীতি ভলিবল টুর্নামেন্ট ছিল। সেখানে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ওমর সাদী প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন।

ভারতের সীমান্ত এলাকা ঘুরে জানা যায়, কাঁটাতার থাকলেও চোরাকারবারিরা বিভিন্ন কৌশলে তার কেটে, উপর দিয়ে ঢিল ছুড়ে অবৈধ মালামাল পাচার করছে। স্থানীয়দের বক্তব্য দুদেশের সীমান্তঁঘেষা মানুষের ভাষা, রং-বর্ণ, পোশাক একই ধরনের। তাই চেনার উপায় থাকে না, কে বাংলাদেশি, কে ভারতীয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেনাপোল, পেট্রাপোলসহ বেশ কয়েকটি সীমান্ত চেকপোস্টে সংশ্লিষ্ট বিজিবি-বিএসএফ সদস্য জানান, শরীরের স্পর্শকাতর বিভিন্ন স্থানে রেখেও সোনা পাচার হচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পণ্যবোঝাই ট্রাকের পর ট্রাক ভারতে প্রবেশ করছে। ওইসব পণ্যের ভেতর, ট্রাকের কোন স্থানে সোনা আছে তা শনাক্ত করা খুবই কঠিন। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি স্থাপন করা হলে সোনাসহ যে কোনো অবৈধ মালামাল জব্দ ও প্রতিরোধ করা সহজ হবে।

এ প্রসঙ্গে বিএসএফের দক্ষিণ বঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল সুরজিৎ সিং গুলেরিয়া বলেন, আমাদের কাছে চোরাকারবারিদের তালিকা আছে। এরা নজরদারিতেই আছে। সোনা চোরাকারবারিদের মধ্যে দুটি স্তর রয়েছে। একটি কিংপিন্সের (মূলহোতা) অন্যটি বহনকারী মাত্র। বহনকারীরাই বেশি আটক হচ্ছে। আমাদের এলাকায় সোনা চোরাচালানকারী চক্রের ৮ জন চিহ্নিত সদস্য আছে, এরাই মূলহোতা। বিভিন্ন গোয়েন্দা মাধ্যমে বাংলাদেশি সোনা চোরাকারবারিদের তালিকার তথ্যও আমাদের কাছে আছে। সেই তালিকা আমরা বিজিবির কাছে দিয়েছি।

ভারতের অংশে কে কে সোনা চোরাচালের সঙ্গে জড়িত বিজিবিও আমাদের কাছে সেই তালিকা দিয়েছে। অর্থাৎ উভয় দেশের সোনা চোরাকারবারিদের তালিকা রয়েছে। অপরাধ মোকাবিলার অংশ হিসাবে আমরা এ ধরনের তালিকা নিয়মিত বিনিময় করি। ’

সুরজিৎ সিং গুলেরিয়া বলেন, আমরা যাদের আটক করছি, এদের মধ্যে সাধারণ মানুষ থাকে। যারা অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। ভুল করে কিংবা মানব পাচারের অংশ হিসাবে ভারতে প্রবেশ করছে। এদের অধিকাংশকেই আটক করে বিজিবির মাধ্যমে বাংলাদেশে ফেরত দিচ্ছি। কারণ এদের বিরুদ্ধে মামলা করলে সাধারণ মানুষগুলো বেশ ঝামেলায় পড়ে। আমরা তা চাই না। আমরা সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে চাই। এ জন্য বাংলাদেশি জনগণ এবং বিজিবির সহযোগিতাও চান এ কর্মকর্তা।

এদিকে সপ্তমবারের মতো সোনা পাচার করতে গিয়ে যশোর সীমান্তের চৌগাছা এলাকায় সাড়ে ১৪ কেজি সোনা নিয়ে ধরা পড়েন শাহ আলম নামের এক সোনা চোরাচালান চক্রের অন্যতম সদস্য। বাংলাদেশ থেকে ভারতে সোনা পাচারের সময় গত ১৯ মে বিজিবি তাকে গ্রেফতার করে। সে কৃষকের বেশে সীমান্ত হয়ে ভারতের দিকে যাচ্ছিল।

জানা যায়, ২০১৪ সালের মার্চ মাসে লরির খালাসি সেজে উত্তর ২৪ পরগনা সীমান্ত এলাকায় আব্দুল বারিক বিশ্বাস নামক এক সোনা চোরাকারবারি চক্রের সদস্যকে ৪৪ কেজি সোনাসহ গ্রেফতার করা হয়।

ইউআর/

- Advertisement -spot_img
- Advertisement -spot_img

সর্বশেষ

- Advertisement -spot_img

এই বিভাগের আরও

- Advertisement -spot_img