কয়েক দশকের মধ্যে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কার মানুষেরা দেশটির প্রেসিডেন্ট অফিসের কাছে বিক্ষোভস্থলেই নতুন বছর উদযাপন করেছেন। ছয় দিন ধরে তারা প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসার পদত্যাগের দাবিতে অবস্থান করে বিক্ষোভ করছেন তারা। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা এখবর জানিয়েছে।
লঙ্কান গৃহযুদ্ধে পঙ্গু হয়ে পড়া প্রবীণরা চুলা জ্বালিয়েছেন, বৌদ্ধ ভিক্ষুরা উচ্চস্বরে ধর্মীয় শ্লোক পড়েছেন। অন্যরা আতশবাজি পুড়িয়েছেন এবং ‘জনগণের সংগ্রাম জয়ী হোক’ স্লোগান দিয়েছেন।
চলমান সংকটের জন্য প্রেসিডেন্টকে দায়ী করে বিক্ষোভকারীরা তার গোটাবায়ার কার্যালয়ের প্রবেশপথ ও আশেপাশে অবস্থান নিয়েছেন। দেশটির প্রভাবশালী রাজাপাকসা পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও দুঃশাসনের অভিযোগ তুলে ক্ষমতা ছাড়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।
স্বামী এবং দশ ও আট বছরের দুই ছেলেকে নিয়ে বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন দিলানি নিরঞ্জলা। তিনি বলেন, অন্য সময় আমাদের সন্তানরা দাদা-দাদির কাছে গিয়ে নতুন বছর উদযাপন করত। কিন্তু আজ আমরা তাদের এখানে নিয়ে এসেছি। যাতে করে তারা দেশের বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, দেশে যে পরিস্থিতি চলছে তা সম্পর্কে আমরা তাদের মিথ্যা কথা বলতে চাই না। চাই না তারা গ্রামে গিয়ে নতুন বছর উদযাপন করুক। অল্প বয়সেই তাদের সত্য জানা এবং সেটিকে ধারণ করে বাঁচতে শেখা উচিত।
নিরঞ্জলার স্বামী উসিথা গামাজ একজন ট্যাক্সি চালক। দ্রব্যমূল্যের চড়া দামে তিনি প্রতিদিন হতাশ হচ্ছেন। তার কথায়, এই লড়াই হচ্ছে বলে আমি খুব খুশি। এতে আমি নতুন আশা ও শক্তি পাচ্ছি। আমরা তাদের ক্ষমতা থেকে নামানোর পর এই নতুন বছর আমাদের জন্য অনন্য হবে। সন্তানদের এটিই বলেছি আমি।
গত কয়েক মাস ধরে শ্রীলঙ্কার মানুষেরা জ্বালানি ও খাদ্য সংকটে পড়েছে। প্রতিদিনই তাদের লোডশেডিংয়ের শিকার হতে হচ্ছে। বেশিরভাগ পণ্য কিনতে হয় মুদ্রা দিয়ে। কিন্তু শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশটিকে ২৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এই বছরেই পরিশোধ করতে হবে ৭ বিলিয়ন ডলার। অথচ দেশটির বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে এসেছে।
রান্নার কেরোসিন, জ্বালানি, গুঁড়ো দুধ কিনতে মানুষকে দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছে। চিকিৎসকরা সতর্ক করে বলেছেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে আবশ্যক ওষুধের সংকট ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।
বিক্ষোভকারীদের মধ্যে খাবার বিতরণে সহযোগিতা করছেন ২৩ বছর বয়সী শিক্ষার্থী থারুশি নিরমানি। তিনি জানান, এই বিক্ষোভ শ্রীলঙ্কার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ঐক্য তৈরি করছে।
নিরমানি বলেন, অতীতে নতুন বছর উদযাপন করত মাত্র দুটি জাতিগোষ্ঠী–সিনহালি ও তামিল– কিন্তু গতকাল রাতে আমাদের সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের অনেকেই মুসলিম। এটি দারুণ ঐক্যবদ্ধতা।
মঙ্গলবার লঙ্কান সরকার ঘোষণা দিয়েছে তারা বিদেশি ঋণ পরিশোধ স্থগিত করছে। এর মধ্যে বন্ড, সরকার-সরকার ঋণ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর কাছে সহযোগিতা ও ঋণ পুর্নগঠন করা পর্যন্ত পরিশোধ স্থগিত রাখা হবে।
সরকার জানিয়েছে, বিশ্বব্যাংক তাদেরকে ১০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে আবশ্যক ওষুধ ও সরঞ্জাম কেনার জন্য। আরও তহবিলের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
সরকারের পক্ষ থেকে প্রবাসী শ্রীলঙ্কানদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে ওষুধ দান বা তা কেনার অর্থ সহযোগিতা করার জন্য।
সমালোচকরা বলছেন, রাজপাকসা সরকার এমন প্রকল্পের জন্য ঋণ নিয়েছে যেগুলো থেকে আয় আসছে না। যেমন চীনা ঋণে একটি বন্দর নির্মাণ।
বিক্ষোভের মূল নিশানায় পরিণত হয়েছে গত দুই দশক ধরে বেশিরভাগ সময় ক্ষমতায় থাকা রাজাপাকসা পরিবার। ক্ষমতা ছাড়তে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসা। যদিও চলমান সংকট ও বিক্ষোভের কারণে তার মন্ত্রিসভার বেশিরভাগ সদস্য পদত্যাগ করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে চারজন মন্ত্রী শপথ নিয়েছেন। কিন্তু বেশিরভাগ মন্ত্রণালয় ফাঁকা রয়েছে।
ইউআর/