গত ২৬ আগস্ট বৃহস্পতিবার ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার চরমজলিশপুর ইউনিয়নের চরলক্ষ্মীগঞ্জ এলাকার মরহুম সামছুল হক (রহ.) নূরানী হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানার এক ছাত্রকে যৌন নিপীড়নের পর হত্যার ঘটনা ঘটেছে। দশ বছরের ওই শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের পর গলা টিপে হত্যা করা হয়।
আদালত সূত্রে জানা যায়, আরাফাত হত্যার কথা স্বীকার করে প্রধান শিক্ষক কথিত বড় হুজুর মোশারফ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে আরাফাত হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার জুহাইর আল ফাইজ ছাড়াও আরো কয়েকজন ছাত্রের নাম উল্লেখ করেছেন। অপর শিক্ষক নূর আলী, মাদ্রাসায় অধ্যায়নরত আরো তিন ছাত্রকে বলাৎকার করেছেন।
আরাফাতের ঘটনা ব্যতীত মোশারফের হাতে আরও ৫ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক নূর আলী আরাফাতের কাছে ৩ শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের বিষয় ছাড়াও আর কোন শিক্ষার্থীর এমন ঘটনার শিকার হয়েছে কিনা সে বিষয়ে বিস্তারিত তদন্তসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে আইনগত পদক্ষেপ নিতে সোনাগাজী মডেল থানার ওসি ও দাগনভূঁঞা থানার ওসিকে নির্দেশ দেন আদালত।
এদিকে মোশারফকে গ্রেপ্তারের পর থেকে স্থানীয় মানুষ তার অপকর্মের বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মো. সাজেদুল ইসলাম জানান, এ বিষয়ে আদালতের আদেশের কপি এখনো তিনি হাতে পাননি। কপি পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অপরদিকে ঘটনার পর থেকে মাদ্রাসার আশপাশের এলাকায় আতংক বিরাজ করছে। আরাফাত হত্যা মামলায় মোশারফসহ তিন শিক্ষক ও এক ছাত্র গ্রেপ্তারের পর অপর শিক্ষকরা মাদ্রাসায় তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে গেছেন। মাদ্রাসার আবাসিকে থাকা ছাত্রদের তাদের অভিভাবকরা বাসায় নিয়ে গেছেন।
স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা যায়, ওই মাদ্রাসার নূরানী ও হেফজ বিভাগে ১১৫ জন শিক্ষার্থী ছিল। আবাসিকে ৪৫ জন থাকতো। ৫ শিক্ষকের মধ্যে তিনজন থাকতেন মাদ্রাসায়।
হেফজ বিভাগের ছাত্র আমির হোসেন গনমাধ্যমে জানান, মোশারফ হুজুর ছাত্রদের প্রায় সময় নির্যাতন করতেন। তিনি তার রুমে ডেকে নিয়ে ছাত্রদের দিয়ে শরীর টিপাতেন।
এছাড়া দিলরাজপুর গ্রামের বাসিন্দা মজিবুর রহমান বলেন, আমি দেখেছি হুজুরেরা বাচ্চাদের দিয়ে গোসলের সময় নিজেদের গায়ে সাবান লাগাতেন। আমি এর প্রতিবাদ করায় স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি আমার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। এছাড়া মোশারফ হুজুর মাদ্রাসায় তাবিজেরও ব্যবসা করতেন।
মাদ্রাসার সভাপতি আবুল বাসার জানান, ঘটনার পর থেকে মাদ্রাসা বন্ধ আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার চালু করা হবে। স্থানীয় ইউপি সদস্য আবু ইউসুফ বলেন, তারা (শিক্ষকরা) নিজের মত লোকদের দিয়ে কমিটি করে মাদ্রাসা চালাচ্ছে। তিনি আরাফাত হত্যার বিচার ও অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
প্রসঙ্গত, গত ২২ আগস্ট রোববার সকালে ওই মাদ্রাসার বিপরীতে দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের মোমারিজপুর এলাকার একটি ডোবায় আরাফাতের লাশ পড়ে থাকতে দেখে স্থানীয়রা। পরে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আরাফাত পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার খবর দেয় আরাফাতের পরিবারকে। মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক মোশারফ নিহত আরাফাতের বাবাকে জানায় তার ধারণা জ্বীন তার ছেলেকে মেরে ফেলেছে। আরাফাত তার বাবা-মাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। পানিতে ডুবে ওই ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে বলে এলাকায় প্রচারও করে তারা। পরে পুলিশ এসে আরাফাতের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ফেনী জেলা সদর হাসপাতাল মর্গে নিয়ে যায়। সাঁতার জানা আরাফাতের পানিতে ডুবে মৃত্যু পরিবার ও স্থানীয়রা মানতে পারছিলেন না।
সেদিনেই আরাফাতের বাবা সানা উল্লাহ বাদী হয়ে অধ্যক্ষসহ ৪ জনের নাম উল্লেখ করে দাগনভুঞা থানায় মামলা দায়ের করেন। এরপর ওই দিন রাতেই মাদ্রাসায় অভিযান চালিয়ে অধ্যক্ষ মোশারফ ও আরাফাতের এক সহপাঠিসহ এজহারে অন্তরভুক্ত আরো দুই শিক্ষক নূর আলী আরাফাত এবং আজিম উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।