নিজস্ব প্রতিবেদক: চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলায় এক মুসলিম নারীকে খুন করে হিন্দু বলে পুড়িয়ে দাহ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি খুনের আলামত নষ্ট করার উদ্দেশ্যে তাকে সৎকার করেছে এমন অভিযোগে ঐ নারীর মা আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।
জানা যায়, খুন হওয়া ইয়াছমিন আক্তার এ্যানী (২৪) বাগেরহাট জেলার মোংলা থানাধীন আফাবাড়ি এলাকা মোঃ ইয়াকুবের বড় মেয়ে। চট্টগ্রাম সীতাকুন্ড উপজেলার ভাটিয়ারী ইউনিয়নের জাহানাবাদ এলাকার জামাল সওদাগরের ভাড়া ঘরে এ্যানীর পরিবার বসবাস করেন।
রোকসানা বেগম (৩৯) কর্তৃক নিজের মেয়ে ইয়াছমিন আক্তার এ্যানিকে হত্যার অভিযোগে গত ১৬ আগস্ট, ২১ইং চট্টগ্রাম চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি সিআর মামলা (নং-১২৯/২০২১) দায়র করেন।
মামলায় মেয়ের কথিত স্বামী বোয়ালখালী উপজেলার জৈষ্ঠপুরা গ্রামের অজিত দে ও দেবী দে’র ছেলে বাবলু দে প্রকাশ তনু (৩০) কে প্রধান আসামী ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ আরও ১৭জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
বাকি অভিযুক্তরা হলেন-চট্টগ্রাম বোয়ালখালী উপজেলার ৮নং শ্রীপুর খরণদ্বীপ ইউনিয়নের রতন চৌধুরী (বয়স উল্লেখ নেই), সাধন মহাজন (৬০), নিমাই দে (৪৫), শংকর দত্ত (৩৩), অরবিন্দ মহাজন (৫০), অরুন দাশ (৫০), দিলীপ দেব (৪৫), প্রদীপ সুত্রধর (৪০), রাম প্রসাদ (৩৮), রনি দে (৩০), অরুপ মহাজন (৪২), সমর দাশ (৫৫), রবীন্দ্র ধর (৬০), নিপুন সেন (৬০), মো. মোকারম চেয়ারম্যান, ইউসুফ প্রকাশ ড্রেজার ইউসুফ (৩৫) ও পবন দাশ (৫৫)।
দায়ের করা মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ইয়াছমিন আক্তার এ্যানি চট্টগ্রাম নগরীর কেপিজেড এলাকায় অবস্থিত একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। কাজের সুবিধার্থে বন্দরটিলা এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। বাসা থেকে কর্মস্থলে আসা যাওয়ার পথে ওই এলাকায় অবস্থিত একটি সেলুনের কর্মচারী নাম বাবলু দের সাথে পরিচয় হয়। পরে প্রনয় এবং তা বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়। বাবলু এবং এ্যানির সংসারে ইশা মনি নামক দেড় বছর বয়সী একটি কন্যা সন্তানও রয়েছে।
মামলায় আরো বলা হয়, হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বাবলু এ্যানিকে বিয়ে করেন। পরে এ্যানি জানতে পারায় এ বিষয়ে তাকে ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে।চাপ থেকে মুক্ত হতেই সুকৌশলে তাকে ঠান্ডা মাথায় খুন করে হিন্দু রীতিতে পুড়িয়ে দেওয়া হয় লাশ। যাতে কোন রকম প্রমাণ পাওয়া না যায়।
বাদি রোকসানা বেগম দাবি করেন, আমার মেয়ে বাবলুর সকল অপকর্ম জেনে যাওয়ায় তাকে প্রায় সময়ই নির্যাতন করত। যা সে তার বান্ধবীদের নিকট জানিয়েছে। সে আমার মেয়েকে হিন্দু ধর্ম গ্রহণে চেষ্টা চালিয়েছিলো। এ্যানী রাজী না হওয়ায় তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে হার্ট এ্যাটাকে মৃত্যু এবং হিন্দু হিসেবে দাহ করে জ্বালিয়ে দেন।
বর্ণিত সুত্রে আরো জানায়, গত ৩ আগস্ট ২০২১ইংরেজী তারিখ বিকালে এ্যানির খালাতো বোন হাসি মারা যাওয়ার খবরটি জানায়। তখন এ্যানীর মা বাবলুর সাথে যোগাযোগ করে মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে হার্ট এ্যাটাক হয়েছে বলে তথ্য দেন। তখন তিনি বাগেরহাট থেকে না আসা পর্যন্ত লাশ দাফন না করার অনুরোধ জানালেও তারা তার মেয়েকে পুড়িয়ে ফেলেছে বলে অভিযোগে জানায়। যেহেতু লকডাউন চলাকালীন অভাব অনটনে পড়ে সীতাকুন্ড ছেড়ে তিনি সে সময় বাগেরহাট অবস্থান করেছিলেন।
এজাহারে আরও বলা হয়, হত্যার আলামত নষ্টের উদ্দেশ্যেই তাকে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। কোন মৃত্যু সনদ কিংবা পুলিশের অনুমতি ছাড়াই কেবল চেয়ারম্যান, মেম্বার, চৌকিদারের দোহাই দিয়ে তার মেয়েকে পুড়িয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে তারা বিষয়টি অতিদ্রুত ধামাচাপা দিতে চেয়েছে।
রোকসানা বেগম বাগেরহাট থেকে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে এসে থানায় মামলা করতে চাইলেও থানা পুলিশ মামলা না নেয়ায় শেষমেষ তিনি আদালতের শরনাপন্ন হন।
মুঠোফোনে জানতে চাইলে বাদি রোকসানা বেগম বলেন, বিশেষ করে এ ঘটনার মূল মাস্টার মাইন্ড হিসেবে কাজ করেছে রতন চৌধুরী, মোকারম চেয়ারম্যান ও ড্রেজার ইউসুফ। এদের সহযোগিতায় আলামত নষ্ট করতে আমার মেয়েকে পুড়িয়ে ফেলেন। ন্যায় বিচারের আশায় আমি আদালতে একটি অডিও রেকর্ডও জমা দিয়েছি।
অভিযুক্ত মূল আসামী বাবলু দে, শ্রীপুর খরনদ্বীপের চেয়ারম্যান মো. মোকারম এর মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ ও ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোন ধরনের সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে অভিযুক্ত আ.লীগ নেতা রতন চৌধুরীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমি এলাকার মেম্বার চেয়ারম্যান নই। আমাকে কেন আসামি করল তা আমি জানি না। সামনে নির্বাচন তাই হয়তো এ কাজটি করল। তবে ঘটনাটি মিথ্যা।’
বাদির আইনজীবি এএম জিয়া হাবিব আহসান জানান, একজন মুসলিমকে হিন্দু বলে পুড়িয়ে মারা খুবই অমানবিক আর নৃশংস। গত ১৬ আগস্ট আদালত পুরো বিষয়টি আমলে নিয়ে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গণ্য করে নিয়মিত মামলা রুজু করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে ৩ দিনের মধ্যে আদালতকে অবহিত করতে বোয়ালখালী থানার ওসিকে নির্দেশ দেন।
ওদিকে, বোয়ালখালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল করিম বলেন, আদালত থেকে আদেশ পাবার সাথে সাথে এসআই সুমন কান্তিদে কে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। তিনি বিষয়টি দেখছেন।’
এসআই সুমন কান্তিদে বলেন, যতদুর শুনেছি গার্মেন্টসে চাকরি করার সময় ইয়াছমিন আক্তার এ্যানীর সাথে বাবলু দের পরিচয় সূত্রে প্রেম-বিয়ে। একটা সন্তানও রয়েছে। আরো জেনেছি মেয়েটি মুসলিম ছিল। গতকাল মাত্র মামলা রুজু হলো তদন্ত চলছে। বিস্তারিত পরে জানানো যাবে।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার নাজমুন নাহার বলেন, বিষয়টি আমি প্রথম আপনার কাছ থেকে শোনলাম। এরআগে কেউ বিষয়টি জানায় নি। এখন খোঁজখবর নিয়ে দেখতেছি। প্রয়োজনীয় কোন ব্যবস্থা নেবার থাকলে অবশ্যই রোলস মতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’